বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় গেলেই কি তবে হুঁশ ফিরবে আমাদের?
১৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:২৩
হে মাননীয়েরা, আর কখন হুঁশ ফিরবে আপনাদের? এই দেশ বঙ্গবন্ধুর দেশ, উগ্র ধর্মব্যবসায়ীদের নয়। ধর্মব্যবসায়ী হটাও, দেশ বাঁচাও!
“…বঙ্গবন্ধুর মূর্তির বদলে আল্লাহ, কোরআন ও হাদিসের বাণী সম্বলিত মিনার স্থাপন করতে হবে।
“…শেখ সাহেবের মূর্তি তো আজকে হোক, কালকে হোক উঠিয়ে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করবো। তখন কিন্তু লজ্জিত হবেন, অপমানিত হবেন…।”
“…বাংলাদেশ মসজিদের দেশ, আউলিয়ার দেশ, মাদ্রাসার দেশ। এদেশে কোনো মূর্তি থাকতে দেওয়া হবে না…।”
“…সারাদেশের সড়কের মোড়ে মোড়ে মূর্তি বসানো হয়েছে সেই সব মূর্তি সরানোর জন্য আন্দোলন করা হবে। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের দর্শনে কোন মূর্তি ছিল না, তাই মূর্তি রাখা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী…।”
২০১৭ সালে যখন সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে আইন অনুশাসনের প্রতিকৃতি গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটিকে মূর্তি দাবী করে সরিয়ে নিতে আন্দোলন শুরু করে ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় হেফাজতে ইসলাম। তাদের প্রবল চাপে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়া হয়। তখন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মপ্রাণ, মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন, প্রবল প্রতিবাদে বারবার সতর্ক করবার চেষ্টা করছিলেন এই বলে যে উগ্র ধর্মান্ধদের কখনোই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। তাদের যত দাবী মেনে নেওয়া হবে, তত তাদের আস্কারা দেওয়া হবে এবং একটা সময় সাহস বাড়তে বাড়তে তারা দেশটা দখল করে নেবে। আফসোস করেছিলেন তারা তখন যে, ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মান্ধতার দীর্ঘ অন্ধকার সময় শুরু হলো বোধহয়। এরপর গত ৩ বছরে পদ্মা, মেঘনা যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে, ধীরে ধীরে বেড়েছে উগ্র ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ীদের আস্ফালন। তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন অর্থাৎ চরমোনাই হুজুর উপরের কথাগুলো বলার স্পর্ধা দেখালেন। কী সহজে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ফেললেন, তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটা তুলে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করবে। অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এই জমিন তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এখানে তারা ইসলামকে ব্যবহার করে, ইসলামের নামে যা খুশি তাই করতে পারে।
সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গাটা হচ্ছে, ইসলামী শাসনতন্ত্রের এই ধর্মান্ধদের বক্তব্য কিন্তু খুব গুছিয়ে তৈরি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি বড় অংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হওয়ায় তাদের ব্রেনওয়াশের জন্য শুরুতেই এরা সেই পুরনো শঠতা ও নোংরা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম ভাস্কর্যকে মূর্তিপূজা বানিয়ে যে নোংরা প্রচারণা চালিয়েছিল, সেই একই মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে ইসলামী শাসনতন্ত্র অর্থাৎ চরমোনাই হুজুর। মূর্তি ইসলামে হারাম প্রচার করে তারা দেশের সকল ভাস্কর্য ভাঙ্গতে চাচ্ছে। অথচ ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ নয়, মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়, উপাসনা বা পূজা করার জন্য মূর্তি, চিত্র বা প্রতিমা তৈরি ও সেটা উপাস্য হিসেবে পূজা করা নিষিদ্ধ। যদি ইসলামে মূর্তি, ভাস্কর্য, শিল্পকলা ইত্যাদি নিষিদ্ধই হতো, তবে প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনবদ্য সব ইসলামী শিল্পকর্মের জন্ম হতো না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের এই ধর্মব্যবসায়ীদের ধারণাও নেই ইসলাম ধর্মের সূচনাকালের উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা শিল্প-সংস্কৃতিতে কতটা সমৃদ্ধ। ইসলামী রেনেসাঁস-এর সময়কার এবং তারপরের অসংখ্য অজস্র মূর্তি, ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম, চিত্রকলা এখনো মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, আলবেনিয়া, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে অহরহ পাওয়া যাবে, যা একইসাথে সেসব দেশ ও ইসলামী গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও কীর্তির স্বাক্ষর রেখে চলেছে যুগের পর যুগ।
জেদ্দার হাল হামারা এলাকায় উন্মুক্ত পার্কে রয়েছে দেশটির সবচেয় বড় ভাস্কর্য জাদুঘর। ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে মানুষ, ঘোড়া, উটসহ নানা ধরনের অজস্র দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য রয়েছে এই জাদুঘরে। তুরস্কের ইদরানি শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে সেলিমি মসজিদের প্রবেশদ্বারের পাশেই রয়েছে কিংবদন্তি নকশাবিদ শিনান বিন আবদুল মেনানের ব্রোঞ্জের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। আনাতোলিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে ইভিলি মিনার মসজিদের সামনেই রয়েছে তুরস্কের জাতির জনক কামাল আর্তাতুকের যুদ্ধংদেহী মূর্তি, সাথে রয়েছে একজন নারী সহযোদ্ধারও মূর্তি। আনাতোলিয়ার গ্র্যান্ড মসজিদের সামনে ঘোড়ার পিঠে উদ্ধত তরবারি হাতে দৃষ্টিনন্দন প্রস্তর মূর্তি রয়েছে, যা জানান দিচ্ছে তুরস্ক ও কামাল আর্তাতুকের শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস। মসজিদের সামনে মূর্তি, তাও আবার নারী মূর্তি— তুরস্কে কিভাবে সম্ভব?
মজার ব্যাপারটা হচ্ছে বাংলাদেশে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের ভক্ত ও সমর্থককুলের কাছে তিনি মুসলিম উম্মাহর ইমাম, আদর্শ নেতা, সাচ্চা মুসলমান। কিন্তু যদি সত্যিই ভাস্কর্য-মূর্তি ইসলামে হারাম হয়, তাহলে একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে কিভাবে এরদোগান তার দেশে হাজার হাজার ভাস্কর্য আর মূর্তি যত্ন করে রাখছেন, ভেঙ্গে ফেলছেন না, সেটার উত্তর এই এরদোগান ভক্তদের কাছে নাই। তারা জানেও না কী পরিমাণ ভাস্কর্য আর মূর্তি রয়েছে তুরস্কসহ মুসলিম দেশগুলোতে। বাংলাদেশে যারা ধর্মব্যবসায়ীদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভাস্কর্যকে উপাসনার মূর্তি ভাবছেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, কেন মধ্যপ্রাচ্যের ইমামরা কখনোই কেন তাদের দেশে স্থাপিত ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি? বাকি দুনিয়ার এতো এতো মুসলিমপ্রধান দেশের শত কোটি মুসলমান তাহলে সহীহ নয়, তাদের চেয়ে এই দেশের ধর্মব্যবসায়ীরা সত্যিকারের সহীহ মুসলমান হয়ে গেলো তাহলে?
মূল ব্যাপারটি হচ্ছে সেখানকার স্বনামধন্য ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফতি-মুহাদ্দিস, আলেম-ওলামাগণ এবং ইসলামী নেতারা জানেন, কোরআন ও রসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করেছেন। মূর্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলোকে মানুষ পূজা দেয়। এর বাইরে যেসব মূর্তি বা ভাস্কর্য রয়েছে, যেসব মূর্তি বা ভাস্কর্য উপাসনার উদ্দেশ্য তৈরি করা হয়নি বা হবে না, তাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, বিরোধ নেই, সেগুলো হারাম হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ কারণেই পৃথিবীর প্রতিটি সমৃদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রে অসংখ্য অজস্র অনবদ্য ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম তৈরি হয়েছে, এসব অঞ্চলের বেশ ক’টি ভাস্কর্য ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মানও পেয়েছে।
অথচ আমাদের দেশে এই ধর্মান্ধের দল তাদের নোংরা ধান্ধাবাজি এবং ক্ষেত্রবিশেষে গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বহুদিন ধরেই মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে মিথ্যাচার চালিয়ে আসছে। এই মূর্তিবিরোধী প্রচারণা শুরুটা ২০০১ সালে উগ্র ধর্মান্ধ তালেবান জঙ্গিদের বামিয়ান উপত্যকায় দুই থেকে তিন শতকে নির্মিত বৌদ্ধমূর্তিটি “নাজায়েজ ও হারাম” প্রচারণা চালিয়ে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে। আফগানিস্তান থেকে জঙ্গি ট্রেনিং নিয়ে আসা উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী পরের বছরগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আলবদরদের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সুবাদে রাষ্ট্রীয় মদদে দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিস্তার ঘটায় বহুলভাবে। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালে ঠিক আফগানিস্তানের বৌদ্ধমূর্তির মতো আমাদের দেশেও এয়ারপোর্টের সামনে স্থাপিত লালন শাহসহ আরও তিন বাউল মূর্তির গলায় রশি বেঁধে টানতে টানতে গুঁড়িয়ে ফেলে এদেশিয় উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীর দল।
সেদিন বাউলের মূর্তির গলায় রশি বেঁধে যে উৎকট উল্লাস প্রকাশ করেছিল ধর্মান্ধরা, সেটা ক্রমেই বেড়েছে দিনের পর দিন। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের সেই পুরনো সাম্প্রদায়িক উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্তরসূরিরা গতকাল তাচ্ছিল্যের সুরে হুমকি দিয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়, তারা এ দেশের সকল ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম সবকিছুই উপড়ে ফেলবে। অর্থাৎ যা কিছু এদেশের জন্য মঙ্গলকর, বাঙালি জাতির গৌরব ও গর্বের যা কিছু অর্জন, ঐতিহ্য আর কিংবদন্তির সকল স্মারক ও স্মৃতিচিহ্ন— ধর্মের নামে, ধর্মকে ব্যবহার করে মুছে ফেলতে চায় এই ধর্মান্ধ অপশক্তির দল।
কিন্তু সেটা খুবই চাতুর্যের সাথে। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইসলামী সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে তারা ভাস্কর্যের জায়গায় আল্লাহ, কোরআন আর হাদিসের বাণী সংবলিত মিনার স্থাপনের দাবী জানিয়েছে। খুব কৌশলে তারা মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত এই দেশের মূল ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চাচ্ছে। এই দেশ যে সব ধর্মের, সব বর্ণের সকল মত ও পথের মানুষের, সবারই এখানে নাগরিক, ধর্মীয়সহ সকল অধিকার সমানভাবে আছে, সেটাকে বাতিল করে এরা ইসলামকে ব্যবহার করে নিজেদের ফতোয়াবাজি চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতির উপর।
সবচেয়ে নোংরা যে খেলাটা খেলছে তারা, সেটা হচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিতে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিতে, অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে উৎসর্গ করলেন, সেই বঙ্গবন্ধুকেও এরা ব্যবহার করছে তাদের নির্লজ্জ ফতোয়াবাজিতে। এবং এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে তারা যেন এই দেশ, এই জমিন সবকিছুই তাদের পৈতৃক সম্পত্তি, তারা যেটা বলবে, সেটাই ইসলামী আইন এবং নিয়ম হিসেবে পালন করতে হবে। তাদের এই স্পর্ধা অচিন্তনীয়, একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে সে রাষ্ট্রের জাতির জনকের ভাস্কর্য তুলে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতে চাওয়ার মত ভয়াবহ স্পর্ধা দেখানো সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই সামিল।
প্রশ্ন হচ্ছে উগ্র ধর্মান্ধ এই মৌলবাদীদের স্পষ্ট হুমকির প্রতিক্রিয়ায় সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে? দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কিংবা অন্যান্য প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া কী? ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের কোনো নেতা কী দলীয় বা ব্যক্তিগত কোনো প্রতিবাদ বিবৃতি পাঠিয়েছেন এই হুমকির প্রতিক্রিয়ায়? একজন নেতাকেও পাওয়া গেল না এই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য? স্পষ্ট প্রতিবাদ করার জন্য? আমরা কী এখনো বুঝতে পারছি না যে এদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে গিয়ে এদের আস্কারা আর সাহস দেওয়া হয়েছে, তার ফলে আজ এরা ফণা তুলে বুক বরাবর ছোবল মারতে উদ্যত। এরা রসূল পাক (সা:)-এর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির নিষেধ অমান্য করেছে নির্দ্বিধায়, ইসলামকে ব্যবহার করে এখন এই দেশের মূল ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে চাইছে। আর কতটা সীমা লঙ্ঘন করলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, দেরী হয়ে যাচ্ছে খুব, আমাদের হুঁশ ফিরবে কবে?