পরিবেশ সুশাসন প্রয়োজন
২১ নভেম্বর ২০২০ ১৪:৩২
বৈচিত্র্যে ভরা জীবজগতে রয়েছে ক্লোরোফিল থাকা এককোষী শৈবাল। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে উদ্ভিদ। এছাড়া রয়েছে ছত্রাক সমবর্গের উদ্ভিদ এবং বহুকোষী শৈবাল। শৈবাল মাছের প্রধান খাদ্য। জলজ খাদ্যশৃঙ্খলের মুখ্য চাবিকাঠি শৈবাল। শৈবালই খাদ্যবস্তুর প্রাথমিক উৎপাদক যা গোটা শৃঙ্খল সচল রাখার শক্তি যোগায়। সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে জলজ জীবে অক্সিজেন সরবরাহে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আসে অপুষ্পক উদ্ভিদ। যাদের মুল, কাণ্ড, ও পাতা রয়েছে। এছাড়া আরও রয়েছে ফার্নবর্গের উদ্ভিদ। এরাই প্রথম স্থলজ উদ্ভিদ। ক্রমে এলো সপুষ্পক উদ্ভিদ। বৈচিত্র্যে ভরে উঠলো উদ্ভিদ জগৎ। এই বৈচিত্র্যই জীবজগত এবং উদ্ভিদ জগতের মূলধারা। এই বৈচিত্র্যকেই বলা হয় সুশাসিত জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য মানে জীবনের বৈচিত্র্য। প্রাণের বৈচিত্র্যও বৈকি। প্রকৃতি জগতের এই বৈচিত্র্যে কোনো বিরোধ নেই। অসংখ্য বৈচিত্র্যের মাঝে প্রকৃতি এক অদ্ভুত ঐক্য তৈরি করে দিয়েছে। যাকে বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐকতান বা মিতালী। বৈচিত্র্য এবং ঐক্য অথবা ঐক্যহীন বৈচিত্র্য কেনোটিতেই প্রকৃতির কোনো সায় নেই। সৃষ্টির ঊষালগ্নে মানুষ ছিল একান্তভাবে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। মানুষ ও পরিবেশ একই সূত্রে গাঁথা ছিল অর্থাৎ পরিবেশ সুশাসিত ছিল। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও মানুষের মধ্যকার মৈত্রী সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে।
প্রকৃতি কিভাবে এই বৈচিত্র্য তৈরি করে? প্রকৃতি এটি তৈরি করে সূর্য, তাপ, মাটি, পানি, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয়গুলো কাজে লাগিয়ে। আর ঐক্যটা গড়ে দেয় কেমন করে? বাস্তুতন্ত্র আর খাদ্যশৃঙ্খল কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি এই ঐক্য গড়ে তোলে। পরিবেশের প্রতি সুনজর না দিয়ে জীবহত্যা আর উদ্ভিদ বিনাশ করে এই বৈচিত্র্য ধ্বংস করা ঠিক হবে না। বাস্তুতন্ত্র আর খাদ্যশৃঙ্খলে বিপর্যয় ডেকে এনে এই ঐক্যকে বিনষ্ট করা যাবে না। এটিই প্রকৃতির বিধান। কারণ প্রাকৃতিক নিয়ম, শৃঙ্খলা বা সুশাসন ঠিক রাখতে হবে। এই বিধান, নিয়ম, শাসন মানুষ যেখানে যে পরিমাণে ভাঙ্গে, সেখানে সে পরিমাণ নিজের বিনাশ সে নিজেই ডেকে আনে। আর প্রকৃতিও এ ব্যাপারে ছেড়ে কথা বলে না। প্রকৃতি তার নানান বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের বৈরিতার কথা নিজের মতো করে স্পষ্ট জানান দেয়।
জীববৈচিত্র্যে অতুলনীয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সুন্দরবন পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা বাদাবন। একক আয়তনে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য এই সুন্দরবনে উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের বৈচিত্র্যই বিস্ময়কর। সুন্দরবনের মতো বৈচিত্র্যময় গাছপালা পৃথিবীর কম অঞ্চলেই রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উঞ্চায়নে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালের সমীক্ষায় বলা হয়েছে ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। আশার কথা— রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বংশ বৃদ্ধি করার চেষ্টা হচ্ছে ।
বিজ্ঞানীরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ হয়েই চলেছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির হিসাবে বিশ্বে প্রায় ২২ কোটি জীব প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ জীব প্রজাতির জীবনকথা জানা গেছে। বলা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ৭০ লাখ জীব প্রজাতি বিলুপ্তি হতে পারে। পাখির সংখ্যা দ্রুত কমছে। নানা প্রজাতির পাখির তিন চতুর্থাংশ পাখি ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে চলেছে। পৃথিবীর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এক চতুর্থাংশ বিলুপ্তির মুখে। প্রতিবছর খাদ্যশস্য, উদ্ভিদ এবং শস্যবীজও দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংসের কারণে সপুষ্পক উদ্ভিদের মোট ১০ শতাংশ আজ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের কতিপয় প্রজাতিও আজ প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হতে চলেছে। গবেষকদের মতে, গড়ে প্রতিদিন ৫০টি প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। তবে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের এই বিপর্যয় ও বিলুপ্তির একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ- প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে স্বাভাবিক বিলুপ্তি।
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের যে বিশাল ভাণ্ডার তার অল্পই বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। জৈব বিবর্তনে লাখ লাখ উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতির আগমন ঘটেছে পৃথিবীতে। আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হচ্ছে অনেক প্রজাতির। যেসব প্রাকৃতিক কারণে এটা ঘটেছে সেগুলো হচ্ছে অগ্নুৎপাত, উল্কাপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভুস্তরের ফাটল, তুষারপাত, বরফ গলা ইত্যাদি। তবুও এসব মোকাবিলা করেই জীববৈচিত্র্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতির নিজের এসব হিসাব-নিকাশ তথা জীববৈচিত্র্যের অব্যাহত ধারার পথেই মানুষ এগিয়ে এসেছে। সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আর এই মানব সভ্যতাই আজ হুমকি দিচ্ছে জীববৈচিত্র্যকে। গোটা বিশ্বেই আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন ঘটছে মানুষের নানান বিবেচনাহীন কাজকর্মের জন্য। জীবনের তাগিদে, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে চলেছে। মানুষ নিজেদের রুচি অনুসারে প্রকৃতি ও পরিবেশ অগ্রাহ্য করে সভ্যতা গড়ে তুলছে।
বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের ‘স্টিম ইঞ্জিন’ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ঢেউ লাগে। শুরু হয় শিল্পযুগ। ব্যাপক হারে পরিবেশ ধ্বংস করে কলকারখানা নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। দেখাদেখি গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে যায় একই হারে উন্নয়ন প্রবণতা। ফলস্বরূপ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, বিশ্ব উঞ্চায়ন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে মানুষ পরিবেশ ধ্বংস করছে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের ভোগ বেড়ে গেছে। মানুষকে তৈরি করতে হচ্ছে আরও শিল্প কারখানা, আরও শহর। শিল্প ও শহরের নানান দূষণ বিষিয়ে দিচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। বাড়ছে পৃথিবীর উত্তাপ। বদল ঘটছে আবহাওয়ার। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ। পরিণতিতে ঘটে চলেছে জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি। সঙ্গে রয়েছে উন্নত দেশের জারী করা নীতি। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশ্বায়ন, গ্লোবালাইজেশন, কর্পোরেট বিজনেস, বহুজাতিক কোম্পানি ইত্যাদি নানান নামে ও নানান রূপে গরীব দেশ থেকে নাম মাত্র মূল্যে কাঁচামাল সংগ্রহ করছে। আবার উৎপাদিত পণ্য গরীব দেশেই বেশি মূল্যে বিক্রি করে শোষণ করছে। এভাবে সহজেই ধ্বংস করা হচ্ছে গরীব দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। পরিবর্তিত আবহাওয়ায় গোটা বিশ্ব আজ হুমকির মুখে। প্রবাহটা পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। অন্যদিকে বেশি ফলন পেতে কৃষি ও বন সৃজনের জন্য সীমিত কতিপয় প্রজাতির ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করছে উন্নত বিশ্ব। ফলে বেশির ভাগ স্থানীয় প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে। নানান দেশে নতুন নতুন প্রজাতির চালান করায় স্থানীয় প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ভুলে গেলে চলবে না, আগে বাংলাদেশে ২০ হাজারের বেশি ধরনের ধান চাষ হতো। কীটনাশক বিষের ব্যবহারে মারা পড়েছে কেঁচো, ছত্রাক, ও নানা রকমের জীবাণু। পোকা মাকড় ফসলের শুধুই যে ক্ষতি করে তা কিন্তু নয়। ফসলের বহু বন্ধু পোকা রয়েছে। যেমন: লেডিবিটল, গ্রাউন্ড বিটল, ড্যামসেল, ঘাসফড়িং, উরচুঙ্গা, ওয়াটার বাগ, বোলতা জাতীয় পোকা এবং নানা ধরনের মাছি। এসবের মধ্যে আরও রয়েছে মাজরা পোকা, গান্ধী পোকা, শীষ কাটি, লেদা পোকা, বাদামি শোষক পোকা, সাদা পিট, শোষক পোকা, শ্যামা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা, ইত্যাদি। এছাড়া কয়েক প্রকার মাকড়সাও আমাদের পরিবেশের বন্ধু। এরা হলো নেকড়ে মাকড়সা, রঙিন মাকড়সা, লাফানো মাকড়সা ইত্যাদি। নানান কায়দায় এই বন্ধু পোকারাই কিন্তু পোকা মারার কাজ করে দেয়। এরা ফসলের শত্রুপোকাগুলো খেয়ে নিজেরা বেঁচে থাকে। এতে মানুষের উপকার হয়। অথচ উন্নত দেশের উৎসাহ ও পরামর্শে ফসলের শত্রু পোকা মারতে গিয়ে কীটনাশক ও রাসায়নিক বিষে মেরে ফেলা হচ্ছে বন্ধু পোকাদেরও। এভাবে কমে যাচ্ছে পোকাদের বৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে খাদ্য ভারসাম্য, প্রবাল দ্বীপ এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় অচিরেই বড় ধরণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র, ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর ১৬০ মিলিয়ন মানুষের আবাস-নিবাস। তবে আশার কথা— পরিবেশ ও প্রকৃতির এই ক্রমবর্ধমান ক্ষতি মোকাবেলার উপায় খুঁজছেন সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, এবং পরিবেশ তত্ত্ববাদীরা। তারা পরিবেশ সুশাসনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার টেকসই উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন।
লেখক: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়