Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় অর্থনীতি বাঁচাতে দরকার কৃষিতে মনোযোগ


২১ নভেম্বর ২০২০ ২৩:২০

২০২০ সালের এক অভিশাপ হলো করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথম লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভীষণ ছোঁয়াচে প্রকৃতির এই ভাইরাসের নামকরণ করে SARS–CoV-2 নামে। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কোভিড-১৯। এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারাবিশ্বে মারা গিয়েছেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। বাংলাদেশের এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখের অধিক। মারা গেছেন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসের প্রভাবে সমগ্র পৃথিবীই এখন লণ্ডভণ্ড। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দীর্ঘ লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। প্রায় দুই থেকে আড়াই মাস দীর্ঘ এসব লকডাউনে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন কমে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি মন্দার দিকে চলে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করেছে।

বিজ্ঞাপন

আশঙ্কা করা হচ্ছে— এ বছর বিশ্বে প্রবৃদ্ধি হবে সর্বকালের সবচেয়ে কম। শুধু তাই নয়, এই ধারা আগামী কয়েক বছর অব্যাহত থাকতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। আশঙ্কার বিষয় হলো— করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার এখন কিছুটা নিম্নমুখী হলেও এটি নির্মূল হওয়ার কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির এই নিম্ন ধারা সহসা পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।

এ বছর বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয় ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মধ্যমেয়াদী দৃশ্যকল্পে’ একটি চিত্র উপস্থাপন করে। সেখানে বলা হয়, আগামী ৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রক্ষেপণ অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.২০ শতাংশ। যদিও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ করোনা পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ হবে বলে মত দিয়েছেন। সরকারের দেওয়া তথ্য মতে, গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশ দেখানো হয়েছে। যদিও সিপিডি সহ বিভিন্ন অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান যেটিকে ম্যানুফ্যাকচারড বলে ঘোষণা করেছে। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরে সরকারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কতটা বাস্তবভিত্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে অঘোষিত লকডাউন চলছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে সে সময় থেকে। কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের শিল্পখাত ও সেবাখাত। এ সময় ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়। বিভিন্ন কলকারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষিত হয়। লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এক দিকে দেশে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি, অন্যদিকে বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে আবার পোশাক কারখানা সহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারি সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের সকল উৎপাদনশীল খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এ বছর দেশের কৃষি খাতে করোনাভাইরাসের আঘাত তীব্র নয়। এ বছর মার্চ-এপ্রিলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরুর দিকেই কৃষির ফসল উঠে গিয়েছে। ফলে অর্ধেক-বছরের জন্য অন্তত খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। আমাদের মনে রাখা উচিত— বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধানতম স্তম্ভ হলো কৃষি। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান প্রায় ৭০ ভাগ থেকে বর্তমানে কমে ১৪ ভাগে এসে দাঁড়ালেও কৃষি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস হলো কৃষিখাত। ফলে কৃষিতে করোনার প্রভাবের ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ। এ বছর দ্বি-ফসলী জমির প্রধানতম ফসল আউশের মৌসুমে করোনাভাইরাস দেশকে স্থবির করে রাখায় বছরের শেষার্ধে বাংলাদেশের খাদ্যের সঞ্চয় কী দাঁড়াবে তা আমরা এখনো জানি না। খাদ্যশষ্য মজুদের ব্যাপারের সরকারের সিদ্ধান্ত এখনো পরিষ্কার নয়। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়েছে বলেও আমরা জানতে পারিনি। এ অবস্থায় করোনাকালে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত থাকার কোনো সুযোগ নেই।

পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতালি, স্পেন-সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশগুলোতে আবার করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহ যাবত ইতালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দীর্ঘ লকডাউনের পরও প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশেও যে সেকেন্ড ওয়েভ করোনা আসবে না তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের প্রধান কৃষি মৌসুম সামনে। আসন্ন শীত মৌসুমে যদি ধান ও গমের উৎপাদন করোনাভাইরাসের প্রভাবে কমে যায় সেক্ষেত্রে আসছে বছর দেশে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। আসন্ন দিনগুলোতে খরিফ মৌসুমের ফসল ধান, পাট, ভুট্টা কিংবা রবি মৌসুমের ফসল গম, মটর, মসুরি ইত্যাদি উৎপাদন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। দানা শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি ও মৎস্য উৎপাদনের দিকেও সম গুরুত্বারোপ করা জরুরি। নতুবা করোনাকালে জাতীয় পুষ্টি সংকটের সৃষ্টি হলে তা করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণকে বৃদ্ধি করবে। এ অবস্থায় আমাদের সরকারি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে এদেশের কৃষিকে রক্ষায় মনোনিবেশ করা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ বছর আমন মৌসুমে দেশের ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও এই ধানের অধিকাংশই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এটি আমাদের দেশের জন্য স্বস্তিকর একটা ঘটনা বটে। তবে এই আহরিত ফসলের থেমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অংশ সরকারিভাবে গুদামজাত করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য নেই।

বন্যাপ্রবণ বাংলাদেশে এ বছর দীর্ঘস্থায়ী বন্যা লক্ষ্য করা গেছে। এ অবস্থায় আউশের উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তীব্র। একই সাথে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়তন ও অধিক জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে এই সংকটকালে খাদ্যশষ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আসন্ন ফসল উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় ফসল ক্রয় ও মজুত করা নিশ্চিত করা জরুরি। মধ্যস্বত্ত্বভোগী মজুতদার, ফড়িয়া ও অসৎ ব্যবসায়ীদের হাত থেকে দেশের কৃষিকে রক্ষা করতে না পারলে আসন্ন বছরে খাদ্য সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা তীব্র। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বেকার মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশ আবারও একটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীব্যাপী জোর চেষ্টা চলছে। মানুষ হয়তো শীঘ্রই এই প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমাদের করোনাভাইরাসের বাস্তবতা মেনেই জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ দীর্ঘ লকডাউনে যায়নি। ভবিষ্যতেও এটি করার মতো সামর্থ্য হয়তো আমাদের নেই। এমতাবস্থায় আসন্ন দিনগুলোতে একদিকে আর্থিক সংকট অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি মিলিয়ে গভীর সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। দেশের মোট উৎপাদন কমে গেলে একদিকে যেমন খাদ্যশষ্য কমে যাবে তেমনি কর্মের সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। কর্মহীন কোটি মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে রিলিফ দেওয়া যেমন বাস্তবতা বিবর্জিত তেমনি তা মানুষকে অলস করে তোলে বলে পন্থা হিসেবেও অগ্রহণযোগ্য। এ অবস্থায় আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি পদক্ষেপই পারে করোনা সংকট থেকে দেশের অর্থনীতিকে মুক্তি দিতে। অন্যথায় আমাদের পরিণতি হতে পারে করুন ও নির্মম।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, পর্তুগাল

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর