Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবক্ষয় নেমে এসেছে


৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৪:০৭

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের কথাই বলেন আর চিকিৎসা ব্যবস্থার কথাই বলেন না কেন— খাতটাকে যে নামেই ডাকেন— এই খাতের অবস্থা কিন্তু ভালো নয়। একশ্রেণীর ডাক্তারদের অমানবিক আচরণ কিংবা তাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের যদি আমরা বিচার বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে দেখতে পাব— তারা ভুলেই গেছেন ডাক্তারির মতো মহান পেশাটা বাজারের আলু পটলের ব্যবসা নয়। চিকিৎসা পেশা মানবিক সেবার একটি বিশেষ দিক। তার মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিছু সংখ্যক ক্লিনিক ব্যবসায়ীরা ধরে নিয়েছে, যেহেতু দেশের অসহায় মানুষ কিছু কিছু ব্যাপারে কিছুই বুঝে না, তাই তাদের কাছ থেকে রক্তচোষা বাদুরের মতো যত পার বিভিন্ন কৌশলে টাকা পয়সা চোষে নিয়ে আসো। তার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন ক্লিনিকের নিয়োগ করা দালালদের উপদ্রবে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালালদের রোগী টানাটানির ব্যাপারটা দেখলে যে কোনো হৃদয়বান মানুষের মন মেজাজ ভালো থাকার কথা নয়।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে অনেক ক্লিনিকের সামনে ঝুলিয়ে রাখা সাইনবোর্ডে দেখা যাবে অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের নাম। বলা হয়ে থাকে সাইনবোর্ডে ডাক্তারদের নাম লেখা থাকলেও বাস্তবে কিন্তু সাইনবোর্ডে নাম লেখা থাকা ডাক্তাররা কখনো এই ক্লিনিকগুলোতে আসেন না। তার মধ্যে আবার আমরা পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী পাশ করা ডাক্তার নয় অর্থাৎ ভুয়া ডাক্তারদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তখন সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এই বলে ব্যাখ্যা দেন যে, তারা ভুয়া ডাক্তারদের সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কেউ কেউ বলে থাকেন বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ মনে করেন নিজেরা যত চালাক, তার চেয়ে দেশের মানুষ অনেক অবুঝ এবং বোকা। আমরা এমন সংবাদও পত্র পত্রিকায় দেখে থাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধৃত ডাক্তার মাধ্যমিকের সীমাই পার হয়নি। আবার অনেক সময় দেখা যায় ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভ পাশ করা ব্যক্তিরা নিজেদের নামের পিছনে বড় বড় ডিগ্রি লাগিয়ে নিজেদেরকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন এবং মানুষের অপচিকিৎসা করে যাচ্ছেন। যখন ধরা পড়ে তখন আসল সত্য বেরিয়ে আসে। তখন জেলার সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনকে প্রশ্ন করলে সিভিল সার্জন কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর মানুষকে দিতে পারেন না।অনেক সময় দেখা যায় সিভিল সার্জনের নাকের ডগার উপর দিয়ে কিছু অসৎ মানুষেরা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ফুটবল খেলছে। অথচ অসৎ একশ্রেণীর সিভিল সার্জনরা এমন ঘুম ঘুমিয়ে থাকেন, যে ঘুমের জন্য আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চলমান অবক্ষয় নেমে আসছে। যাদের ঘুম হয় না তারা ঘুমের ঔষধ খায়। ঠিক তেমনি অসৎ সিভিল সার্জনরা একধরণের অনৈতিক ঘুমের ঔষধ খেয়ে জেগে থেকে ঘুমিয়ে থাকেন। এই অনৈতিক ঘুমের ঔষধ হলো অর্থ আর বিত্ত। দায়িত্বরত অসৎ সিভিল সার্জনরা কিংবা তারও উপর মহলের অসৎ বড় কর্তারা সমস্ত নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অর্থবিত্তের এতটাই দাসত্ব করছেন যে, যার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যখাতের আজকের এই করুন অবস্থা। অনেকেই বলে থাকেন ভুয়া ডাক্তার এবং অসৎ ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের অসৎ কর্তা ব্যক্তিরা টাকা পয়সা খেয়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বলতে গেলে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছেন। নীচ থেকে উপরের পর্যন্ত অসৎ কর্তাব্যক্তিরা এতটাই দুর্নীতিবাজ হয়েছেন যে, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সরকারি হাসপাতাল থেকে সরকারের দেওয়া ঔষধপত্র বাজারে বিক্রি হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

বিজ্ঞাপন

সারা পৃথিবীতে যখন কোভিড-১৯ হানা দেয় তখন পৃথিবীর সকল কোণার মানুষের জীবন-যাপন এলোমেলো কিংবা তছনছ হয়ে যায়। ইউরোপসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান দেশের মানুষ এই কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বলতে গেলে অমানবিক জীবন যাপন করতে থাকে। পৃথিবীর মানুষকে কোভিড-১৯ আতঙ্ক এতটাই পেয়ে বসে যে, মানুষ আপন সন্তানকে কাছে টানতে দ্বিধা করতে থাকে কিংবা বন্ধুবান্ধব আপন সন্তানকে কাছে আসতে না দিয়ে দূরে রাখতে থাকে। কোভিড-১৯ তাণ্ডবলীলায় এখন পর্যন্ত প্রায় বারো লক্ষের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এই মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে কেউ বলতে পারছে না। মৃত্যুর হিসাব এখানেই যে থেমে থাকবে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও আমরা কোভিড-১৯ তাণ্ডবলীলার মধ্যেই দেখতে পাই লোভী বর্বর দুর্নীতিবাজ লম্পট মানুষের আনন্দের নৃত্য। এতো মৃত্যু দেখেও অসৎ দুর্নীতিবাজদের মধ্যে বিন্দুমাত্র বোধোদয় ঘটেনি। তারা মানুষের দুরবস্থা নিয়ে তাদের দুর্নীতি ও লাম্পট্য ঠিকই চালিয়ে যেতে থাকে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় আমাদেরই দেশমাতৃকার মানুষের যখন খুবই করুন অবস্থা, তখন এসব শিক্ষিত দুর্নীতিবাজরা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে শুরু করল তাদের অনৈতিক ব্যবসাপাতি। কোভিড-১৯-এর সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজরা দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কাটতে শুরু করল। আর তখনি আমরা দেশবাসী জানতে পারি রিজেন্ট কিংবা জেকেজির মত নৈতিকতাহীন সংস্থার কথা। তখন মানুষ দেখতে পায়, এদেশের লেখাপড়া জানা একশ্রেণীর মানুষ কতোটা নিষ্ঠুর আর ধান্ধাবাজ হতে পারে। দেশের মানুষের যখন খুবই করুন অবস্থা তখন একশ্রেণীর লোক মানুষের সকল করুন অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করল লুটপাট। চোর বাটপাররা মানুষের পকেট কাটতে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তারা ভুলে গেল সকল শুরুরই যেমন একটা শেষ আছে, তেমনি সকল অন্যায়েরও একটা শেষ আছে। তখনি আমরা দেশবাসী জানতে পারলাম সাহেদ ও ডা. সাবরিনার কথা। সাহেদের হাত এতই লম্বা ছিল যে, দেখা যায় দেশের উচ্চস্তরের মানুষের সাথে তার উঠাবসা চলাফেরা। এমনকি দেশের উচ্চস্তরের মানুষের চেম্বার থেকে শুরু করে সর্বত্র তার যাওয়া আসা। আবার দেখা যায় টিভির টকশো’তে কথা বলে সে আমাদের মতো মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝাচ্ছে।

প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আমার জানা মতে (যদি ভুল না করে থাকি) একটা গান আছে এরকম— “থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিফেনা/ বাঘে মহিষে খানা এক সাথে খাবে না/ মরি স্বভাব তো কখনো যাবে না”। আমাদের দেশের নৈতিকতা বর্জিত মানুষ যতই লেখাপড়া করে আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কবি, সাংবাদিক, লেখক, গায়ক, হোক না কেন তাদের আসল স্বভাব যদি হয় পরধন হরণ করা, তাহলে সে স্বভাব কখনো সহজে যায় না। যা আমরা নষ্ট মানুষের বাস্তব জীবনে কর্মকাণ্ড দেখেই বুঝতে পারি। আমাদেরকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, লেখাপড়া করে আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কবি, সাংবাদিক, লেখক, গায়ক হয়ে দামী কাপড় পরে দামী গাড়িতে চড়লেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না। ভদ্রলোক হতে হলে নৈতিকতার প্রয়োজন হয়। একটা মানুষের মধ্যে নৈতিকতা তখনই দেখা দেয় যখন সে ন্যায় অন্যায় বোধ বিচার করে নৈতিকতার চর্চা করে।

একশ্রেণীর মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ কতটা নীচে নামলে মৃত ডাক্তারের সই দিয়ে কোভিড-১৯ এর রির্পোট দিয়ে থাকে মানুষকে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদ ভাষ্যে বলা হয় যে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এক চিকিৎসকের নাম ও স্বাক্ষর ব্যাবহার করে রোগীদের প্যাথলজি রির্পোট দিত ঢাকার শ্যামলীর একটি চিকিৎসা সেন্টার। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মচারীকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রমমাণ আদালত। পরে শ্যামলীর ওই প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। সেখানে অভিযান চালালে সেন্টারটিতে ভুয়া ল্যাবের সন্ধান পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, শ্যামলীর চিকিৎসা সেন্টারটি হার মানিয়েছে রিজেন্ট কিংবা জেকেজিকেও। প্রতিষ্ঠানটি মে মাসে মারা যাওয়া এক ডাক্তারের নাম ও স্বাক্ষর ব্যাবহার করে অক্টোবরেও রির্পোট দিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো সেন্টারটিতে এক দুইটি টেস্ট করা হতো আর বাকীগুলোর রির্পোট দেওয়া হতো অনুমানের ওপর ভিত্তি করে।

এই যদি হয় আমাদের চিকিৎসা সেবার চিত্র, তাহলে আমরা সাধারণ অসহায় দেশবাসী তলানির কোন পর্যায়ে আছি, পাঠক/পাঠিকারা একটু ভেবে দেখুন। মূলত আমাদের অসৎ কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন তাদেরকে কোনো না কোন দায়িত্ব দিয়ে মানুষের মঙ্গলের জন্য সরকার বসিয়েছেন। তাদের কাজ হলো মানুষের সেবা করা এবং বিভিন্ন অব্যবস্থা থেকে শুরু করে সকল চুরি-চামারী প্রতিরোধ করা। কিন্তু একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিরা যদি দায়িত্বহীন, জ্ঞানহীন মানুষের মতো তাদের ওপর অর্পিত সকল দায়-দায়িত্বের কথা ভুলে নিজেরাই চুরি-চামারীতে লেগে যান, তাহলে তো আমাদের দেশে একশ্রেণীর চিকিৎসা সেন্টার থেকে মৃত ডাক্তারের নাম স্বাক্ষর ব্যাবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাসের রির্পোট দেওয়া হবেই।

ক্ষেতের মধ্যে বেড়া দেওয়া হয় গরু-ছাগল যাতে ক্ষেতের ফসলে মুখ দিতে না পারে কিংবা ক্ষেতের ফসল যাতে নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু বেড়া যদি গৃহস্থের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে কিংবা ক্ষেতের ফসলে মুখ দেয়, তাহলে কি সেই ক্ষেতের ফলানো ফসল চাষি তার ঘরে তুলতে পারবে? কথায় বলে, শুটকির নৌকার বিড়াল যদি হয় মাঝি, তাহলে সেই শুটকি (শুকনা মাছ) কখনো গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। আসলে এখন সর্বত্র একশ্রেণীর চোর-বাটপারদের আধিপত্য বিরাজ করছে। ভালো মানুষের পাঁচ পয়সারও দাম নেই। তাই ভালো মানুষের কোথাও স্থান পাওয়া কঠিন ব্যাপার। সংবাদপত্রে ভাষ্যমতে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিধিত্বকারী স্বাস্থ্যখাতে কোভিড-১৯ মহামারিকালে ব্যাপক ভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজ পেয়েছে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বলা হচ্ছে, আইনের শাসনের ঘাটতি ছাড়াও চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়, নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা সেবা, ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কোভিড-১৯ মহামারিতে ঘোষিত দুই হাজার পাঁচশত টাকা নগদ সহায়তা পেতে প্রত্যেক উপকারভোগীকে দুইশ বিশ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। নগদ সহায়তার তালিকাভুক্ত হতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে ১২ শতাংশ উপকারভোগী।

তাই বলছিলাম, উপরের সমস্ত কথার বিচার বিশ্লেষণ করলে পাঠক/পাঠিকারা একটা কথাই বুঝবেন, আর তা হলো— এদেশের সাধারণ অসহায় মানুষ দুর্নীতি কিংবা চুরি-চামারী করে না। এদেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে থাকে একশ্রেণীর শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা। দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত ভদ্রলোকরা যদি সৎ হয়ে যান, তাহলেই দেশের মানুষ সুখে থাকবে এবং সকল অনিয়ম থেকে রক্ষা পাবে। আমার এই কথার সাথে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই সবাই শতভাগ গ্যারান্টি দেবেন।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর