সময় এসেছে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে অগ্রাহ্য করার
১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:১৭
একসময় ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্বের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর্চ বিশপ, পাদ্রি, পোপ হয়ে উঠেছিলেন সর্বেসর্বা। ঈশ্বর এবং স্বর্গ-নরকের ভয়ে রাষ্ট্র থেকে রাজা-প্রজা সবাই ভ্যাটিকান পোপের সেবাদাসে পরিণত হয়। তাদের মস্তিষ্কে এটাই ভর করে ছিল যে, পরপারে পোপই হলেন এক মাত্র মুক্তির উপায়। তার ছাড়পত্র ব্যতীত কেউ স্বর্গে যেতে পারবে না।
পরিস্থিতি এমন ছিল— কে কী খাবে কী খাবে না, কী পরবে কী পরবে না, কার সঙ্গে যুদ্ধ কার সঙ্গে মিত্রতা কে কয়টা বাচ্চা নেবে কী নেবে না, কাকে বিয়ে করবে কাকে করতে পারবে না, সেটা পর্যন্ত গির্জা নির্ধারণ করে দিত।
ধর্মান্ধতা মানুষের মগজে এতটাই জেঁকে বসেছিল— মৃত্যুর আগে মানুষ টাকা-পয়সা ধনসম্পদ-সম্পত্তি চার্চ ও পাদ্রিকে দিয়ে এক টুকরো কাগজে স্বর্গে যাওয়ার ছাড়পত্র নিয়ে রাখত। পরে মারা গেলে তার কবরে সেই কাগজের টুকরো টুকুন দিয়ে দেওয়া হতো। কোনো বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির আবিষ্কার যদি ভুলেও বাইবেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতো বা চার্চ ও পোপের আদেশ নির্দেশের বাইরে যেত, তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। নারীদের বেলায় ডাইনি উপাধি দিয়ে হাত পা বেঁধে লোহার কড়াইয়ের মধ্যে সেদ্ধ করা হতো।
ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো পোপ যখন ঈশ্বরের নামে ক্রুসেডের ডাক দিলেন। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসার বিষ ছড়ানো হলো। পোপ সবাইকে মহান ধর্মযুদ্ধে যাওয়ার আহ্বান জানালেন। এই যুদ্ধে যারা প্রাণ দেবেন তারা বিনা প্রশ্নে স্বর্গে যাবেন। যারা যোগ দেবে না, তাদের জন্য রয়েছে নরকের অভিশপ্ত আগুন।
ধর্মান্ধ হুজুগে জনগণ দলে দলে যোগ দিল এই নৃশংস যুদ্ধে, তরতাজা প্রাণ তরুণ ছেলেমেয়েদের এক টুকরো স্বর্গের লোভে যুদ্ধে পাঠাতে লাগল বাবা মা। পর পর ক্রুসেড নামক নির্মম বীভৎসতার পরিণাম আমরা কম-বেশি জানি। শুধুমাত্র ধর্মের নামে হাজার হাজার তরুণ, তরুণীর প্রাণ গিয়ে ছিল অঙ্কুরিত হবার আগেই। গির্জার প্রলোভনে পড়ে ধর্মান্ধ মানুষগুলো তাদের এক জীবনের সকল ধন সম্পদ টাকা পয়সা গির্জা আর পাদ্রিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে জনগণ অসহায় হলো, অন্যদিকে পাদ্রি ও গির্জা সহায় সম্পদে ফুলেফেঁপে একাকার।
বিপত্তিটা বাধালেন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি। তার খুব শখ ছিল ছেলে সন্তানের বাবা হবেন। কিন্তু স্ত্রী গর্ভে জন্ম নিলো মেয়ে, তার নাম রাখা হলো মেরি। ভেঙ্গে পড়া হেনরি এক পর্যায়ে তার রানীর থেকে মন সরিয়ে নিলেন। জড়িয়ে পড়লেন রানীর এক সখীর সঙ্গে গোপন প্রণয়ে। তার নাম ছিল এনিবোলিন, যিনি ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের মা।
হেনরির সঙ্গে প্রণয়ের এক পর্যায়ে এনিবোলিন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। তখন হেনরি উপলব্ধি করলেন, এনিবোলিনের যে সন্তান হবে সে যদি ছেলে সন্তান হয় তবে তার সিংহাসন রক্ষা হবে। কিন্তু সেই সন্তানের চাই সামাজিক স্বীকৃতি, চাই হেনরি এনিবোলিনের বৈবাহিক পরিচয়। সবদিক ভেবে হেনরি ঘোষণা দিলেন— তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করবেন। পাশাপাশি তিনি এও বলে দিলেন যে, এনিবোলিনের সন্তান হবে ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার।
কিন্তু হেনরির এ সিদ্ধান্তে বাদ সাধল ইংল্যান্ড চার্চের আর্চ বিশপ ও ভ্যাটিকান পোপ।
পোপের লোভ ছিল ইংল্যান্ডের রাজা উত্তরাধিকার না রেখে যদি মারা যান তবে রাজ কোষাগার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ভ্যাটিকানের হাতে। হেনরির ঘোষণা তাদের স্বার্থে আঘাত করল। এর পরিপ্রেক্ষিতে পোপ বাইবেলের বিধিনিষেধ তুলে ধরলেন, মৃত্যুর পর আযাবের ভয় দেখালেন। অষ্টম হেনরি স্বর্গে যেতে পারবেন না সেটা ও বললেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের নিয়ম মতে, স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য বিয়ে করা বাইবেল স্বীকার করে না। সুতরাং, ধর্মীয় রীতি লংঘন হবে এই কারণ দেখিয়ে আর্চ বিশপ হেনরির এ বিয়ে অবৈধ ও এনিবোলিনের গর্ভে থাকা সন্তানকেও অবৈধ বলে ঘোষণা দেন।
চতুর হেনরি বুঝলেন আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের এখনই দমন করার সময়। নইলে তার সিংহাসন টিকবে না। পোপের এমন বাড়াবাড়িতে রেগে যান হেনরি। ততদিনে অনেকেই গির্জার পাদ্রিদের যৌন নির্যাতন, অর্থ তসরুপ, ধর্ম ব্যবসা, দখলদারিত্ব, নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করে ছিল। গির্জা ও পাদ্রিদের বাড়াবাড়িতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ইউরোপ জুড়ে ঘটে রেনেসাঁ। এরকম পরিস্থিতি মানুষ দিন দিন যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে লাগল।
খ্রিস্টধর্মের এক নতুন সংস্করণ মত সৃষ্টি হলো, যার নাম প্রোটেস্টান রিফর্মেশন আন্দোলন। রাজা হেনরি এ সুযোগটিকে কাজে লাগালেন। তিনি সুযোগ বুঝে সমগ্র ইংল্যান্ড থেকে ক্যাথলিক আর্চ বিশপদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন ও চার্চ থেকে বের করে দিলেন। একইসাথে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। নতুনভাবে তিনি চার্চে আর্চ বিশপ নিয়োগ দিলেন। এবার হেনরি নিজের নিয়োগ দেওয়া আর্চ বিশপের কাছে জানতে চাইলেন তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করলে তা ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কিনা? খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন আর্চ বিশপের রায় হেনরির পক্ষে যায়।
একইসাথে যদি আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে তাকাই— সেই প্রাচীনকাল থেকেই মন্দির পুরোহিত ব্রাহ্মণ্য সমাজের শোষণ নিপীড়ন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। ধর্মের নামে, সহমরণের নামে হিন্দু নারীদের জীবন্ত পোড়ানো হতো মৃত স্বামীর চিতায়। নিচু জাতের মানুষ ছিল অচ্ছুৎ নিঃস্পৃহতা। ছোট জাতের হাতে খাবার খেলে হতো অন্য পাপ।
এখনও ভারতের বহু অঞ্চলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সন্তানের নামে নাম রাখা হলে ছোট জাতের সে সন্তানকে হত্যা করা হয়। উচ্চ বর্ণের সঙ্গে নিম্ন বর্ণের করও বিয়ে হলে হত্যা করা হয়। তাদের বসবাসের স্থান ভিন্ন, পথ ঘাট আলাদা। একে অপরকে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। ঈশ্বর ও মন্দির ধর্মগ্রন্থ এসবের ইজারা ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতের হাতে। আর ধর্মের ব্যবহার করেই মানুষের উপরে চলে শোষণ-নির্যাতন, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড। ধর্মগুরু ভণ্ড অসভ্যরা হয় সমাজপতি। সেই হাজার বছর ধরে।
ভারতের প্রাচীন মন্দিরগুলোতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ সোনাদানা, মনি-মুক্তা-হিরা পড়ে আছে ঈশ্বরের নামে। মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো কাজে আসছে না। অথচ ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুর্দশা জনগণের নিত্যদিনের সঙ্গী।
ঠিক একই চিত্র আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রত্যক্ষ করছি। হেফাজত, জামাত, চরমোনাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের উগ্র উন্মাদনা ধর্মের নামে অপরাজনীতি, অপব্যাখ্যা। চরমোনাই ফজলুল করিম বলেন, “আজকে আপনি যদি হাত পাখা প্রতীকে ভোট দেন, তাহলে ভোটটা পাবে আল্লাহর নবী”। এভাবেই তিনি ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। শিরক কুফরি নাম দিয়ে প্রগতির কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা করছেন। অথচ এরাই এতিম মিসকিনের নামে আসা মধ্যপ্রাচ্যের অর্থ সাহায্য সহযোগিতা লুটেপুটে খায়। তারাই মাদ্রাসায় শিশুদের উপরে হওয়া বলাৎকারের মতো জঘন্য নির্যাতন সযত্নে লুকিয়ে রাখে। তারাই বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষার বিরোধী। অথচ তাদের ছেলে মেয়েরা ইউরোপ-আমেরিকায় লেখাপড়া করে। ইহুদি-নাসারাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নীতি গ্রহণ করলেই ইসলাম যায় সোরগোল তুলে। দেশের শান্তিকে দুর্বিষহ করে তুলতে চায়।
আজ যখন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক করে তুলতে চেয়েছেন, তখনই এই স্বার্থান্বেষী ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের আতে ঘা লেগেছে। আজ যখন দেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি বেগবান, মানুষের পেটে ভাত-পকেটে টাকা, ঠিক তখন ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে এই ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি। ধর্মের নামে জাতিকে বিভাজিত করতে চাইছে তারা। আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে ঐতিহাসিক চির চেনা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রঙকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চাইছে।
যার নেতৃত্বে এই দেশ সৃষ্টি হয়েছে, যার ডাকে সাড়া দিয়ে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশ নামের আত্মপরিচয়ের জন্ম দিয়েছে, আমাদের জাতির পিতার ভাস্কর্য এরা বুড়িগঙ্গায় ফেলার হুমকি দেয়। তর্জন গর্জন করে। অতীতে পাকিস্তান সময়ে ধর্মের নামে ইসলাম যায় শোরগোল তুলে বাঙালির ন্যায্য দাবি অধিকারকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। আজও সেই অপচেষ্টা অব্যাহত।
আমাদেরও সময় হয়েছে রাজা অষ্টম হেনরির মত বলা— আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের উগ্র উন্মাদনা সহ্য করা হবে না। বাংলাদেশ পরিচালিত হবে তার নিজস্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা নির্মিত সংবিধানের আইনের আলোকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত জাতীয় চার নীতির ভিত্তিতে। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ হতে পারে না। সময় এসেছে ইউরোপের মতো সকল অন্ধকার পেছনে ফেলবার, উন্নয়ন ও বিকাশের সুফল স্পর্শ করবার।
লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঝালকাঠি জেলা শাখা