বগুড়ায় বিকৃত ভাস্কর্য ‘বীর বাঙালি’ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন
১২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:৪৮
উত্তরবঙ্গের অগ্রসর জনপদ বগুড়া। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরপরই রংপুর থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট বগুড়া শহরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় স্বাধীনতাকামী যুবকদের প্রবল প্রতিরোধে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন আজাদ, টিটু, তোতা, হিটলু, ছনু, দোলন, তারেকসহ অনেকেই। পরে এপ্রিলের মাঝামাঝি— অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে পাক বাহিনী বগুড়া শহর দখল করে নেয়। ক্রোধ মেটাতে পুরো শহর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় হানাদাররা। যা থেকে বাদ পড়েনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর সম্পত্তির দেখভাল করা বগুড়া মুসলিম লীগের সভাপতি মরিস সাহেবের বাড়িও। এছাড়া যুদ্ধের শুরুর দিকে পাক হানাদারদের হাতে নিহত হন বগুড়ার প্রখ্যাত চিকিৎসক টি আহমদের কিশোরপুত্র মাসুদ, আজীবন মুসলিম লীগার কসিরউদ্দীন আর মোনায়েম খাঁ’র মন্ত্রিসভার সদস্য ফজলুল বারী। আর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে বগুড়ায় চলে নারকীয় তাণ্ডব। যাতে প্রাণ হারান বগুড়া শহরের অদূরে রামশহরের কহরউল্লাহ পীর পরিবারের ১৩ জন।
কাছাকাছি ওই সময়ই শহরের ভেতরে স্থানীয় রাজাকার আনিছারের সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। যারা সে সময় সেহরি খাচ্ছিলেন। আটক ওই ১৪ জনকে ভোরের আলো ফোটার আগেই শহরের উত্তরে বাবুরপুকুর নামক জায়গায় লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়া পুরো সময়টাতে বিহারী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় বগুড়াতে বর্বর হত্যাকাণ্ড চলে। অন্যদিকে সম্মুখযুদ্ধে এই শহরের অনেক বীর যোদ্ধা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন— যাদের অন্যতম মাছুদুল আলম খান চান্দু। যার নামে শহরে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে। ১৯৭১ সালের বগুড়ার এই কৃতি সন্তানদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে শহরের মূল কেন্দ্র সাতমাথায় ১৯৯০ সালে স্থাপিত হয়েছিল ‘বীর বাঙালি’ নামের একটি ভাস্কর্য। যার ভাস্কর ছিলেন সুলতানুল ইসলাম। বগুড়া পৌরসভা এটি স্থাপন করেছিল। ভাস্কর্যটি খুবই দৃষ্টিনন্দন ছিল। একজন বলিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধার কাঁধে রাইফেল, হাতে শান্তির পায়রা। যে পায়রাটি ঊর্ধ্ব আকাশে মুক্ত করার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন ওই যোদ্ধা। এতে খুব সহজেই দেখা যেত বগুড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিচ্ছবি। এই শহরের নাগরিক বা অন্য শহরের কেউ, সবারই নজর কাড়তো ভাস্কর্যটি। দিনে দিনে ভাস্কর্যটি শহরের অন্যতম ‘আইকন’-এ পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু এটা খুব ভালোভাবে নেয়নি মৌলবাদী শক্তি। ১৯৯৩ সালে রাতের আঁধারে স্বাধীনতা বিরোধীদের আক্রমণে ভাস্কর্যটি ক্ষত-বিক্ষত হয়। মূল বেদি থেকে আছড়ে ফেলা হয় মুক্তিযোদ্ধাকে। তবে সুধীজন ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবীর মুখে ভাস্কর্যটির সংস্কার করে অনেকটা আগের রূপে ফিরিয়ে এনে একে উত্তর দিক থেকে বগুড়া শহরের প্রবেশ পথ বনানীতে স্থাপন করা হয়।
সম্প্রতি ভাস্কর্যটি আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এবার সংস্কারের পর যে রূপে এটি স্থাপন করা হয়েছে তা রীতিমত ভয়ংকর। অসামান্য বিকৃত করা হয়েছে ভাস্কর্যটির। এতে ‘বীর বাঙালি’র জায়গায় চলে এসেছে একজন পাকিস্তানি সেনার আদল। মুখে গোঁফের শ্রী দেখে সহজেই একে পাকিস্তানি সেনা মনে হয়। যার চেহারায় বাঙালি কোনো কাঠামো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর সুলতানুল ইসলামের পায়রা এখানে পরিণত হয়েছে একটি হাঁসে। একটি হাঁস আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, কী ভয়াবহ বিকৃতি!
এছাড়া নতুন কাঠামোতে বুট পড়া, আঁচড়ানো চুল, গালে তিল আর আয়ত চোখে ভাস্কর্যটি এমন বিকৃত করা হয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমরা যারা কিশোর বয়স থেকে ভাস্কর্যটি দেখেছি তাদের কাছে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের এক বীভৎস প্রতিরূপ। ভাস্কর্যটি ‘বীর বাঙালি’র চরিত্র হারিয়েছে। পূর্বে যে ভাস্কর্যে বগুড়ার বীরদের অবয়ব কল্পনা করা যেত, এতে এখন সহজেই ফুটে ওঠে পাকিস্তানি সেনার চেহারা। ভাস্কর্যটির এই বিকৃতি বগুড়ার বেশিরভাগ মানুষকে আহত করেছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এখনও জানাচ্ছেন। তাদের মনে বড় প্রশ্ন— মুক্তিযুদ্ধের এমন বিকৃত ভাস্কর্য কিভাবে অনুমোদন করল প্রশাসন। যতদূর জেনেছি– বছরখানেক আগে বগুড়ায় নতুন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব নিয়েছেন। যিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরই শহরের সাতমাথাকে সাইনবোর্ড মুক্ত করে শহরটিকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনিসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে বগুড়ার সন্তান হিসেবে আকুল আবেদন, দয়া করে বিকৃতি এই ভাস্কর্যটি পূর্বের অবস্থান ফিরিয়ে আনুন। যাতে বগুড়ার আগামী প্রজন্ম সহজেই কল্পনা করতে পারে এই মাটির বীর সন্তান শহীদ তোতা, চান্দু, ছনু, তারেক ও টিটু সহ অন্যদের।
লেখক: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়