বিজয় হয়েছে আজ লাল ও সবুজের
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:২৯
কবি নজরুল বলেছিলেন, “অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, কাপুরুষ ভয়ে কাঁপে লড়ে যাবে বীর।” বীরের জাতিতে ভূষিত বাঙালি কখনো পরাভূত হবার নয়। সকল অশুভ পরাজিত অন্ধকারের অপশক্তিকে নিধন করে এই জাতি এগিয়ে যাবেই। পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের বিজয় হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অশ্রু, সম্ভ্রম আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল সে বিজয়। দীর্ঘ নয় মাসের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের প্রধান শক্তি-উৎস। উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত একটি অন্ধ জাতিকে স্বপ্নমুখী, রক্তমুখী, মুক্তিকামী ও স্বাধীনতার বাসনাকে করেছেন জাগ্রত। বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, এদেশের মুক্তি সংগ্রামের মাইলফলক ও প্রেরণার উৎস ছিলো।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে ইয়াহিয়া খান। ফলে বাঙালি স্বায়ত্তশাসন থেকে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বী-জাতিতত্ত্বের ফসল পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটে। এই বিজয় অর্জনে মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সরকার বাঙালি বংশদ্ভুত পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে গণহত্যা এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক সকল ঘটনা এবং অবস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি এবং সেই সঙ্গে পূর্ব হাইকমান্ডের কমান্ডার কোন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে সেটাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়। এই কমিশন পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্য দায়ী কিছু মানুষকে চিহ্নিত করে কেবল, সামগ্রিকভাবে এটি যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অন্যায্য অন্যায় পাশবিক আগ্রাসন ছিলো সেটি স্বীকার করেনি।
জেনারেল নিয়াজী এই কমিশনের চোখে হয়ে ওঠে প্রধান ভিলেন যাকে একজন অদক্ষ, কাপুরুষ ও চরিত্রহীন সেনাপ্রধান রূপে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ২৫ মার্চের গণহত্যার পরিকল্পনাকারী টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী এভাবে তিরস্কৃত হননি কমিশনের কাছে । উল্টো কমিশন উল্লেখ করে যে, রাও ফরমান আলী যুদ্ধকালীন সময়ে গভীর আন্তরিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করেছেন।
জেনারেল নিয়াজী তার “বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” বইয়ে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ১৯৭১ সালের অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়ে, কোন রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সব বদনামের দায় নেবার জন্য তৎকালীন রাজনীতিবিদরা সামনে ঠেলে দেয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, রাও ফরমান আলী ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে ছিলো। কারণ সে জানত, যেহেতু সে প্রচুর বাঙালি হত্যার মূল পরিকল্পনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাই পূর্ব পাকিস্তানে সে অবস্থায় বাঙালিদের হাতে রাও ফরমানের জীবন একদম নিরাপদ নয়। তাই সে নিয়াজিকে তখন অনুরোধ করে তার পোস্টিং পশ্চিম পাকিস্তানে করে দেওয়ার জন্য।
অন্যদিকে রাও ফরমান আলী উল্টো নিয়াজীকে একজন ছিঁচকাঁদুনে জেনারেল হিসেবে আখ্যা দেয়, যে কিনা ৭ ডিসেম্বর থেকেই বাঙালি যোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের ভয়ে প্রায়ই কান্নাকাটি করতো। ফরমান তার বইতে স্বীকার করে যে, ৭০-এর নির্বাচনে রাজনৈতিক অর্থায়নের জন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের চাপ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম পন্থী দলগুলোকে সাহায্য করার জন্য ২২- ২৩ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতে গিয়ে বাঙালি ও অবাঙালি মিলিয়ে লক্ষাধিক প্রাণের নাশ হয়েছে যুদ্ধের সেই বাস্তবতাও ফরমান স্বীকার করেছে। এক পর্যায়ে ২৫ শে মার্চের মধ্যরাতের কথা লিখতে গিয়ে সে লেখে, “এর পরে কারবালা কাহিনী । ইসরাফিল যেন হুংকার দিয়ে উঠলো। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে আমাদের নেমে পড়তে হলো। পাকিস্তান রক্ষার নামে আমরা দ্রুত অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম এবং দীর্ঘ নয় মাস আমরা অসংখ্য প্রাণ সংহার করেও নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারিনি। শতাব্দীর কান্না বিজড়িত একটি মুহূর্তে জেগে উঠলো একটি জাতি।”
সেই যে জয়ী হয়েছিল মানুষ, পরেও তাকে জয়ী হতে হয়েছে শত বাধা পেরিয়ে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল একাত্তরের ঐক্যে ফাটল ধরা। বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসও।
বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা বাণিজ্য, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি যোগাযোগ, আবাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অর্জনের পরিচয় দিয়েছে। বাঙালির এই আত্মশক্তি সুপ্ত ছিলো, সুপ্তই থেকে যেত— যদি না মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারতাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়