করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিনের পাশাপাশি ‘সামাজিক ভ্যাকসিনও’ জরুরি
৯ জানুয়ারি ২০২১ ২০:২৩
বিজ্ঞান নানাভাবে চেষ্টা করেও বশ মানাতে পারেনি করোনাভাইরাসকে। কোথাও কমেছে, কোথাও বেড়েছে। কোথাও ধরন বদলেছে। কোথাও প্রথম ঢেউ, তো কোথাও দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। করোনা বিষের ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাসিয়ে নিয়েছে গোটা বিশ্ব। করোনা কবে যাবে, কীভাবে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই এখনও। তাই শেষ ভরসা ভ্যাকসিন। আর এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও এবার রেকর্ড হয়েছে। এর আগে এত অল্প সময়ে কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি।
আগে যেখানে ছয়-সাত বছর লেগে যেত, এবার সেখানে ছয়-সাত মাসেই ভ্যাকসিন চলে এসেছে। এরইমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ অক্সফোর্ডের যে ভ্যাকসিন
কেনার চুক্তি করেছে, সবাই আশা করছে জানুয়ারি মাসের শেষে বা বড় জোর ফেব্রুয়ারির শুরুতে তা চলে আসবে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কিনতে প্রাথমিক অর্থ (৬’শ কোটি টাকা) ছাড়ের পর দেশের মানুষকে সেই ভ্যাকসিন প্রয়োগে পুরোদমে প্রস্ততি শুরু করেছে সরকার। এ জন্য নানান পরিকল্পনার পাশাপাশি তার বাস্তবায়ন ও তদারকিতে গঠিন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল ডেপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ভ্যাকসিনেশন প্ল্যান ফর কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইন বাংলাদেশ’। মূলত এই কমিটির নেতৃত্বেই চলবে মহাযজ্ঞ।
বিশাল এই আয়োজনে তৈরি করা হচ্ছে প্রায় ১ লাখ কর্মীবাহিনী। যাদের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজে সরাসরি মাঠে থাকবেন অন্তত ৭২ হাজার কর্মী। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেবেন তারা। ওই কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কয়েক ধাপে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। প্রথম ধাপে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। যার মধ্যে আবার ১০ শতাংশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৩ শতাংশ ধরে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন। আর বাকী ৭ শতাংশ, ১ কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জনকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। প্রায়োরিটি তালিকা করার সময় যেন ন্যায্যতা আর সমতার বিষয়টা মাথায় রাখি। কে কত বড় পদে চাকরি করে, কে কত বড় ভিআইপি; তা যেন বিবেচ্য না হয়। লাইনের বাইরে গিয়ে যেন আমরা আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি না করি।
কিন্তু ভ্যাকসিনই কী করোনা সমস্যার শেষ সমাধান? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। বিশ্বের জনসংখ্যা এখন প্রায় ৮০০ কোটি। হার্ড ইমিউনিটির ধারণার প্রয়োগ করতে হলেও অন্তত ৬০০ কোটি লোককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। আর করোনা ভ্যাকসিনের ডোজ দুটি করে। প্রথমটি দেওয়ার অন্তত ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। ৬০০ কোটি লোককে দুটি করে দিলে ১২০০ কোটি ভ্যকসিন লাগবে। ১২০০ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন কঠিন নয় শুধু, রীতিমত অসম্ভব। আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হলেও দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই স্রেফ ভ্যাকসিনের ওপর ভরসা করে করোনা জয় করা সম্ভব নয়।
যারা ভাবছেন, ভ্যাকসিন দিয়ে নিউ নরমাল ভুলে ওল্ড নরমাল জীবনে চলে যাবেন; তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ভ্যাকসিন আসুক না আসুক, আপনি আগে পান আর পরে; ভ্যাকসিনের পাশাপাশি সোশ্যাল ভ্যাকসিনের প্রয়োগের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি, প্রয়োজনে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিনের ধারণা চালিয়ে যেতে হবে। একটা বিষয় মাথায় স্পষ্ট করে গেঁথে নিন, আপনি আর কখনোই করোনাপূর্ব বিশ্বে ফিরে যেতে পারবেন না।স্বাস্থ্যবিধিই হলো আপনার আসল ভ্যাকসিন। এটা চালিয়ে যেতে হবে।
বলছিলাম বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের কথা। অক্সফোর্ড আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনটি তৈরি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। আমরা সেখান থেকে ৫০ লাখ ডোজ করে ধাপে ধাপে ৩ কোটি ডোজ পাবো। জুন মাস নাগাদ জাতিসংঘের মাধ্যমে আরো ৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা। তার মানে সব প্রতিশ্রুতি ঠিকঠাক মতো পালিত হলে আমরা আপাতত পাবো ৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। যা সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে দেয়া যাবে। অথচ ১৮ কোটি মানুষের জন্য বাংলাদেশের দরকার ৩৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। কাগজে-কলমে হিসাবটা এমন হলেও বাস্তবে অত ভ্যাকসিন লাগবে না।
প্রথম কথা হলো, ৮০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পারলেই হার্ড ইমিউনিটি চলে আসবে। তখন আর করোনা ছড়াতে পারবে না। আবার ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের ভ্যাকসিন লাগবে না। সে হিসেবে বাংলাদেশের অন্তত ১২ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। ১২ কোটি মানুষের জন্য লাগবে ২৪ কোটি ভ্যাকসিন। আপাতত এই পথ অনেক লম্বা। তাই আগে যা বলেছি, ভ্যাকসিনের আশায় বসে না থেকে বা ভ্যাকসিন দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে; এই ধারণা ঝেড়ে ফেলে সামাজিক ভ্যাকসিনের ধারণায় আস্থা রাখুন।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেয়েও এর পরিবহন, বিতরণ, প্রয়োগ আরও বড় কর্মযজ্ঞ। ভ্যাকসিন কার্যকারিতার জন্য কোল্ড চেইন অনুসরণ করে বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন ছড়িয়ে দেওয়া অরেক বড় আয়োজন। প্রকৃতি বৈষম্য পছন্দ করে না। করোনা ভাইরাসও সব মানুষকে সমানে আক্রমণ করে চলেছে। নেতিবাচক হলেও বৈষম্যমুক্ত বিশ্বের ধারণার প্রয়োগ করেছে। কিন্তু আমরা নিজেদের বৈষম্যমুক্ত রাখতে পারি না। কারা আগে পাবে, ভ্যাকসিন আসার আগে থেকেই এই আলোচনাটা চলছে। উন্নত দেশের সবাই পাবে, নাকি গোটা বিশ্বে যার যার দরকার তারা আগে পাবে এই নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।
আগেই বলেছি, করোনা এক বৈষম্যহীন ভাইরাস। করোনা কিন্তু সীমান্ত চেনে না। তাই গোটা বিশ্বকে একটা ইউনিট ধরে হিসাবটা করলে বিষয়টা সহজ হতো। কারণ উন্নত বিশ্বের সবাই পেলেও গরীব দেশে যদি ভাইরাসটি থেকে যায়, তাহলে আবারও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। করোনা ভাইরাস থেকে ভালো থাকতে হলে, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। আলাদা করে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ভালো থাকার সুযোগ নেই, উপায়ও নেই। এটা আমরা জানি কিন্তু মানি না বা মানবো না।
ভ্যাকসিন আসার সঙ্গে সঙ্গেই কার আগে কে পাবে, তা নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে যাবে। যেমন, বাংলাদেশে প্রথম দফায় যে ৫০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে, তা ২৫ লাখ লোককে দেওয়া যাবে। কিন্তু কারা হবেন সেই সৌভাগ্যবান ২৫ লাখ? তবে এখানে কিন্তু সৌভাগ্যের কোনো ব্যাপার নেই। লটারি করে কিন্তু নির্ধারণ করা হবে না, কারা আগে পাবে। আসলে সবাই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন এবং সবাই চাইবেন, তিনিই যেন সবার আগে ভ্যাকসিন পান। কিন্তু এই প্রায়োরিটি ঠিক করবে সরকার। এখন পর্যন্ত সরকারের যা পরিকল্পনা তা ঠিকই আছে।
করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী, শিক্ষা কর্মী, গণপরিবহন কর্মী ও সংবাদকর্মীরা পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন পাবেন। তবে আমার আশঙ্কা এই প্রায়োরিটি তালিকা নিয়ে নয়ছয় হবে, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রাম হবে। ক্ষমতার দাপট, অর্থের দাপটও দেখার আশঙ্কা রয়েছে। করোনার শুরুতে চিকিৎসা নিয়ে যে অব্যস্থাপনা হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনাটা যেন ঠিকঠাক মতো করা যায়। সরকার নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই প্রায়োরিটি ঠিক করবে। আমরা যেন হল্লা করে সেটা উল্টে না দেই।
সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা দেন না এমন অধ্যাপকের চেয়ে করোনা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের চালক আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার দাবিদার। প্রায়োরিটি তালিকা করার সময় যেন ন্যায্যতা আর সমতার বিষয়টা মাথায় রাখি। কে কত বড় পদে চাকরি করে, কে কত বড় ভিআইপি; তা যেন বিবেচ্য না হয়। লাইনের বাইরে গিয়ে যেন আমরা আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি না করি।
করোনা আমাদের যে বৈষম্যহীন সমাজের ধারণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা যেন তা বাস্তবে প্রয়োগ করি। করোনা পরবর্তী বিশ্ব যেন আরও মানবিক, বৈষম্যহীন ও ন্যায্যতার হয়। আমি মনে করি, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের প্রতিটি ধাপেই অধিক সতর্কতা জরুরি। একটু ভুল বা অবহেলায় ঘটে যেতে পারে অনেক কিছু।