জ্ঞান আমাদের হাতের মুঠোয়, শুধু চাইতে হবে
১৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৭:২৫
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এমন কিছু সম্ভবত নেই যা আমাদের হাতের বাইরে বা সম্পূর্ণ অজানা। কোনো কিছু জানতে চাইলে গুগল কিংবা ব্রাউজারে সার্চ করলেই চলে আসে সেই বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। সচক্ষে প্রত্যক্ষ না করেও নিখুঁত জ্ঞান লাভ করতে পারি সেই বিষয় সম্পর্কে। যেমন, কেউ যদি নিউইয়র্ক সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে গুগলে সার্চ দিলেই চলে আসবে নিউইয়র্ক শহরের আদ্যোপান্ত। অথচ যে ব্যক্তি নিউইয়র্ক সম্পর্কে জানতে চায়, সে হয়ত কখনও নিউইয়র্কে যায়নি বা কোনো বইপুস্তকেও পড়েনি শহরটির সম্পর্কে। কিন্তু জ্ঞান লাভের এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রজন্মের খুব কম ছেলেমেয়েই অজানাকে জানার চেষ্টা করে।শুধু কোনো কিছু জানার আগ্রহের দিক দিয়েই যে তারা পিছিয়ে আছে তা নয়, শুদ্ধ বানান লেখার ক্ষেত্রেও সেই অর্থে তেমন অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমার কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই সেই সত্য অভিজ্ঞতাগুলো অবলম্বনে কিছু ঘটনা উল্লেখ করলাম।
ঘটনা ১
সাদাতের (ছদ্মনাম) ক্লাসের একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। করোনাকালে পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য ওর স্কুলের প্রতিটি সেকশনেরই একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। ওদের গ্রুপে সবাই ইংরেজিতে ম্যাসেজ বিনিময় করে। রুবাইয়াৎ (ছদ্মনাম) নামের একটি ছেলে প্রায় বেশিরভাগ সময়ই ইংরেজি বানান ভুল লেখে। তো একদিন হলো কী, ক্লাসের বিষয়ে কী যেন ও লিখেছিল। সেখানেও ভুল বানান ছিল। তা সাদাতের চোখে পড়ল। তখন সে রুবাইয়াতে বানানের ভুল ধরিয়ে দিয়ে তা ঠিক করতে বলল। রুবাইয়াৎ ধন্যবাদ জানালেও শোভন (ছদ্মনাম) নামের অন্য এক ছেলে বলে, “U dnt hv to corrct his splling. We cn undrstand wht hve he wrtten. So u dnt need to teach him.” সাদাত কোনোভাবে ছেলেটার সাংকেতিক ইংরেজি বুঝতে পারল। এতে ও কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। তারপর ও শোভনকে নানাভাবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু শোভন প্রতিনিয়ত ওর সঙ্গে তর্ক করছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তাদের ঝগড়া চলল। রুবাইয়াৎ তাদের ঝগড়া থামানোর অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু শোভন তো মানতে নারাজ, সাদাতের সঙ্গে ঝগড়া চালিয়েই যাচ্ছে। যেন ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’—এমন ঘটনা ঘটল। পরে অনেক তর্ক পাল্টা-তর্কের পর তাকে ইংরেজির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলো। শোভন ওর কাছে অনিচ্ছাসত্ত্বে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলো।
ঘটনা ২
পল্লব (ছদ্মনাম) ওদেরই স্কুলের একজন স্যারের কাছে অঙ্ক শেখে। ওর সঙ্গে কিছু বন্ধুরাও পড়ে। করোনার কারণে সামনাসামনি পড়তে না পারায় ওদের ব্যাচেরও একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। স্যার ২৯ নভেম্বর থেকে ওদের ছুটি ঘোষণা করলেন। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে ওদের অঙ্ক পড়াবেন না। ফলে গ্রুপে তেমন কোনো কাজ নেই, যেহেতু স্যারের পড়া বন্ধ। একদিন পল্লব স্যারকে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি আর্টিকেল পড়াল এবং জিজ্ঞাসা করল, স্যার এটা কি আমাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দিতে পারি? স্যারের আর্টিকেলটা পড়ে বেশ ভালো লাগল। স্যার বললেন, যেহেতু এখন গ্রুপে বিশেষ কোনো কাজ নেই তাই এরকম শিক্ষামূলক আর্টিকেল দিতেই পারো। যথারীতি স্যারের অনুমতি পেয়ে খুশি হয়ে পল্লব আর্টিকেলটা ওদের গ্রুপে দিলো। সবাই বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করলেও অপূর্ব (ছদ্মনাম) নামের একজন বলল, এসব অপ্রয়োজনীয় লেখা গ্রুপে দেওয়ার দরকার কী? তখন স্যার বললেন, এখন তো আমি তোমাদের গ্রুপে কোনো অঙ্ক করাচ্ছি না; এই ছুটিতে যদি একটু পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পাও তাহলে তোমার ক্ষতি কোথায়? পরে অপূর্ব পল্লবের কাছে ক্ষমা চাইলো।
উপরের ঘটনাগুলোর মতো এরকম অসংখ্য অপূর্ব-শোভন রয়েছে যারা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে প্রায়ই অনীহা প্রকাশ করে। হয়ত তারা মেধাবী; স্কুলে তাদের রেজাল্টও ভালো। কিন্তু তাদের মেধা অনেক ক্ষেত্রেই পাঠ্যবইয়ের ভিতর সীমাবদ্ধ। পাঠ্যবই বহির্ভূত জ্ঞান অল্প কিছু ছেলেমেয়ের থাকে। হয়ত যে ছেলেটি সবসময় পরীক্ষায় ইংরেজিতে ১০০-এর মধ্যে ১০০ পায় সেই ছেলেটি কোথাও ইংরেজি লেখার সময় এমন কোনো ভুল করে যা সম্পূর্ণ আশাতীত। হয়ত অনেকেই তার বক্তব্য বুঝতে পারে, তাই কেউ তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয় না। একারণে সেই ভুলগুলো আর শোধরায়ও না। এসব বিষয় যে কোনো মানুষের মেধাগত বিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। কারণ একজন মানুষ যদি আরেকজনের ভুল না শোধরায় তাহলে তা শোধরানোর সুযোগই আসে না। কিন্তু যখন
ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ হয় তখন সেই সুযোগকে অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত; কারণ শোধরানো বিষয়গুলোই মানুষের ভালোভাবে মনে থাকে।
আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদেরই দেখা যায় একটু ফুরসত পেলেই পাবজি কিংবা ফ্রি ফায়ারের মতো গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এমনকি একসময় এগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। অথচ এগুলো ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ অবদান রাখে না। এই ফুরসতের সময়টুকু যদি তারা ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশন কিংবা এ ধরনের বিষয়সমূহ যেগুলো মানুষের কৌতূহল, জ্ঞানপিপাসা বৃদ্ধি করে সেগুলোর পেছনে ব্যয় করত, তাহলে তারা একেকজন হীরার রত্ন হতে পারত। এসব বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান একদিকে যেমন তাদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে তেমনি দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও রাখে অনস্বীকার্য ভূমিকা। তাই আমরা যদি পাবজি-ফ্রি ফায়ার নামক মাদক গ্রহণ না করে একটু জ্ঞানপিপাসু ও অনুসন্ধিৎসু হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হব। কারণ জ্ঞান আমাদের হাতের মুঠোয়, শুধু চাইতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ