আতিউর রহমান; আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অনন্য কারিগর
২৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:০২
পদ্মাসেতু। জ্বি হ্যাঁ। পদ্মাসেতু একটি আবেগের নাম। একটি মহা স্বপ্নের নাম আমাদের পদ্মা সেতু। কত নাটক, কত টিটকারি আর কত ষড়যন্ত্র! দেখতে দেখতে হয়ে গেলো বাংলাদেশের পদ্মাসেতু। অথচ বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অসত্য ধুয়া তুলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়নে অসম্মতি জানায় এবং সরকারের শীর্ষস্থানীয় মহল থেকে পদ্মাসেতু নিয়ে বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়া পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব’। তখন দেশের স্বার্থ রক্ষায় এদেশেরই এক লড়াকু নীতিনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদের অনমনীয় ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়ে তিনিই দৃঢ়কন্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই এই পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব।’
তিনি আতিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর এবং খ্যাতনামা বাংলাদেশি উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ। গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একজন স্বনামধন্য প্রবক্তা তিনি। গভর্নর থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও সাহসী নেতৃত্বে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভিযাত্রার অন্যতম অগ্রপথিক হিসেবে একটি সফল এবং সৃষ্টিশীল কাল পার করেছেন। তার আরও পরিচয়-একজন গবেষক, মৌলিক চিন্তাবিদ ও মননশীল লেখক। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণার কারণে তিনি বেশ সুপরিচিত। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই তার লেখা অসংখ্য বই রয়েছে। তিনি রবীন্দ্র বিশ্লেষণধর্মী সাহিত্য আলোচক-প্রবন্ধকার। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন, বাজেট, দারিদ্র্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তার বইগুলো পাঠক সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত। তার ‘পিজেন্ট অ্যান্ড ক্লাসেস’ রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে অনেক আগে থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তার অনেক নিবন্ধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে।
আতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শৈশবে এই মানুষ মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের চৌকস ছাত্র ছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারী আতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং ১৯৭৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাস্টার্স পাস করেন। এরপর লন্ডনে পিএইচডি শেষ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো পদে দীর্ঘমেয়াদী দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশ বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভিজিটিং প্রফেসর, ফেলো হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক—সোনালী ব্যাংকের পরিচালক, জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সৃজনশীল উদ্ভাবনী আইডিয়া, সহজাত নেতৃত্বগুণ, গণমুখী চরিত্র এবং ডিজিটাল জনসংযোগের কারণে তিনি তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়। দরিদ্রের ব্যাংকার এবং সবুজ গভর্নর হিসাবেও তার সাফল্য বিশ্বজোড়া।
ব্যাংকিং সেক্টরের আধুনিকায়নে তার উদ্ভাবনীমূলক ভাবনা ছিল দূরদর্শী। ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত অনুগত থেকে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক ও মানবিক ব্যাংকিং ধারণা প্রবর্তনে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্ত’ নামে উন্নয়নের বাস্তবভিত্তিক দুরন্ত এবং দুর্দান্ত অভিযান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু নতুন পথ ও বিষয়ের উন্মোচন করেন যেগুলো তখনকার সাধারণ প্রথার মধ্যে পড়ে না। বরং ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এই লড়াকু অর্থনীতিবিদ, অ্যানালগ ব্যাংকিং থেকে একটি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক সেক্টরকে ব্যবহারিকভাবে দ্রুত আধুনিক ডিজিটাল হিসেবে বদলে ফেলেন। সনাতনী সমাজ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ডিজিটাল সমাজে সবেমাত্র পা দেওয়া তখনকার বাংলাদেশে বদলানোটা অতো সোজা ছিল না। প্রথম দিকে না বুঝে অনেকেই তার কর্মকাণ্ডকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করেছেন। মারাত্মক সব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তার একনিষ্ঠ প্রায়োগিক প্রচেষ্টায় ব্যাংকিং সেক্টরে- বিকাশ, ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথ, অনলাইন ব্যাংকিং ইত্যাদির সফল রূপান্তর ঘটেছে।
শুধু কি তাই? উন্নয়নের পক্ষে মানবিক ব্যাংকিংয়ের জীবন্ত কিংবদন্তী আতিউর রহমান ‘সিএসআর’ নামে ব্যাংকিং খাতের অর্জিত মুনাফার একটি অংশ জনকল্যাণে ব্যয় করার কড়াকড়ি নিয়ম চালু করেন। ফলে ব্যাংকগুলোর স্কলারশিপ নিয়ে গ্রাম-গঞ্জের হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায়। নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষত রিকশাওয়ালা, মহিলা পোশাক শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেন। ক্ষুদ্র এসএমএস (টেক্সট বার্তা) বা অ্যাপস-এর মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা করতে নির্দেশ দেন। তার প্রবর্তিত এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক এখন ৫ কোটি ২৬ লাখ। দেশে প্রতিদিন ১,২০০ থেকে ১,৩০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এই লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। করোনাকালে মানুষ যখন ঘর থেকে বেরুতে পারেনি। তখন কেনাকাটা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। করোনাকালে সরকার অসহায় মানুষকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। একইভাবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও কর্মসংস্থান ও সেবাপ্রাপ্তির এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সার্বিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং সেক্টর, আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি, রেমিট্যান্স দ্বিগুণ হয়ে যায়। তার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি, গ্রিন ব্যাংকিং, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল ব্যাংকিং (বর্তমানে জমা ১,৪৯৪ কোটি টাকা।) ছাড়াও ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ, নতুন উদ্যোক্তাদের এসএমই ঋণ ইত্যাদি শত শত সফল ও সৃজনশীল দেশীয় খাতে অর্থ বিনিয়োগ করায় দেশের আর্থিক সেক্টর সমৃদ্ধ হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয় তিনগুণ এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়। ব্যাংকগুলো সেবা প্রদানের লক্ষ্যে আড়াই হাজার নতুন শাখা খোলে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চলে আসে ব্যাংকিং সেবায়। বাংলাদেশে নীরব ক্ষুদ্র- অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যায়। যা এর আগে বাংলাদেশে তো নয়ই, বিশ্বের অন্য কোনো দেশেও ঘটেনি।
সময় যায়। কত কিছুই না বদলায়। বদলে দেয়, বদলে যায়। এমনকি নৈতিকতা, আদর্শ, বিশ্বাসের বোধটুকুও। তবে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা বদলান না। তারা রয়েছেন, থাকবেন। থাকবেন তাদের আদর্শিক অবস্থানের কারণে। নৈতিকতার শক্ত অবস্থান ও দৃঢ়তার কারণে। আতিউর রহমান তেমনই একজন আপাদমস্তক সৎ মানুষ। তার যে গুণ এই প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হলো তার কথা ও কাজের সততা। শুধু নিজে সৎ, তা কিন্তু নয়। তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীদের সততার ব্যাপারে বরাবরই তিনি অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে। ফলে তার কার্যকালে তাকে ব্যবহার করে কেউ কোনো অনৈতিক সুবিধা নিতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক তো দূরের কথা, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রভাববিস্তার, দালালি, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি করেছে এমন বদনাম আজ পর্যন্ত তার ঘোরতর শত্রুরাও দিতে পারেননি। সততার অঙ্গীকার কত শক্ত-দৃঢ় হলে নৈতিক অবস্থানে এমন অনড় থাকা যায়?
অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানের সরাসরি ছাত্র আমি ছিলাম না। প্রচলিত অর্থে তার কাছে অ্যাকাডেমিক ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি। তবে ছাত্র তো বটেই। বলা যায় তার হাত ধরেই আমার গবেষণা শেখার হাতেখড়ি। তিনি বিআইডিএস-এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো থাকাকালীন ‘মানব উন্নয়নে মাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা’ বিষয়ক এক গবেষণা প্রকল্পে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে তার অধীনে দীর্ঘদিন চাকরি করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বিভিন্ন সভা সেমিনারে তার প্রচুর বক্তৃতা শুনেছি। কী মনোমুগ্ধকর! তার বক্তৃতা নিঃসন্দেহে চমৎকার, ডিজিটাল ও আকর্ষণীয়। যা শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট করে, টেনে রাখে। মনে জাগায় সম্ভাবনার প্রত্যাশা। আমার কাছে তাকে সবসময় আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় তিনি একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক ও উন্নয়ন অর্থনীতির যোদ্ধা। তার জীবনযাপনে বাহুল্য দেখিনি। গ্রামের মেঠোপথে বেড়ে উঠা, তিল তিল করে আপন মহিমায় জীবনযুদ্ধে জ্বলে উঠা ষোল আনা খাঁটি এক লড়াকু বাঙালির প্রতিরূপ তিনি। তার জীবনের সত্যিকার কাহিনী এই প্রজন্মের মনে প্রেরণা যোগায়। তার শ্রেষ্ঠত্ব তার নিরলস পরিশ্রমী কর্মেরই স্বীকৃতি। আতিউর রহমান একজন সুপণ্ডিত। দারিদ্র, উন্নয়ন অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় তার রয়েছে অবাধ বিচরণ। নির্মোহ মনোভঙ্গী নিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন জীবনের দীর্ঘ পর্ব। জ্ঞান ও উদ্দীপনা দিয়ে বাংলাদেশের জন্য অসংখ্য আধুনিক তরুণ-তরুণী ব্যাংকার তৈরি করেছেন। আরও অসংখ্য তারুণ্যের জন্য পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।
আমাদের জীবনে আতিউর রহমান এক প্রয়োজনীয় উপস্থিতি। দেশের নানান ক্রান্তিকালে লিখনি ও বক্তৃতায় নানাভাবে তিনি আমাদের পথ দেখান। করোনাকালে এখনও ডিজিটাল ওয়েবিনারে সভা-সেমিনারে সমান সক্রিয় রয়েছেন তিনি। দু’হাতে লিখে চলেছেন অবিরাম। সমকালীন বিবিধ বিষয়ে তার ভাবনার বস্তুনিষ্ঠ নির্দেশনা দেখা যায় তার কলাম লেখায়। দেশের আর্থসামাজিক ও মানবিক উন্নয়নে নীতি কৌশল গ্রহণ ও রূপায়নে নিরন্তর ব্যাপৃত রেখেছেন। মানুষের অচেনা ও আদর্শের জায়গাগুলোতে জোরালে আলো ফেলেছেন। এ ধরনের প্রাগ্রসর মানুষের কোনো নাম হয় না। এক সময় তার নাম তার চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। চেতনাশৈলীর মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধ এসব আলোকিত মানুষরা নামের চেয়ে অনেক উপরে বাস করেন। তার উন্নয়ন অর্থনীতির নতুন দর্শন দেশের সমৃদ্ধিতে বাস্তবে কাজে লেগে গেছে দেখে আমরা অন্তর থেকে তাকে শ্রদ্ধা জানাই।