Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশীয় ব্যবসায়ীরা কেন বড় পদে বিদেশিদের নিয়োগ দেন?


২৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:১৮

দেশের বিখ্যাত এক শিল্পগ্রুপের মালিক তিনি। জীবনে বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পোড় খাওয়া লোক। মানুষ চেনেন, মানুষকে পড়তে পারেন ভালোভাবেই। না হলে কি আর এত বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারেন! কাজের সূত্রে পরিচয় প্রায় এক দশক আগে। বিশাল শিল্পপতি হলেও ভদ্রলোক খুব অমায়িক আর নিরহংকারী। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলে আমার মতো অতি সামান্য একজনকেও পাঁচ-দশ মিনিট সময় দেন, কথাবার্তা বলেন। তার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাই বিদেশি—ভারত, শ্রীলংকা, হংকং, তাইওয়ান, মিশর ইত্যাদি নানা দেশ থেকে আসা। কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম তার আরেকটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে—সেও ভারতীয়। তার কয়েকদিন পরেই এক অনুষ্ঠানে উনার সঙ্গে দেখা। কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে একটু অনুযোগের স্বরেই বললাম—
“স্যার, আমার একটা অভিযোগ আছে।”
“বলেন, বলেন, কী অভিযোগ?” তিনি বললেন।
“আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানে এত এত বিদেশি নিয়োগ দেন কেন? দেশের লোকেরা কী দোষ করল?”

বিজ্ঞাপন

ভদ্রলোক প্রথমে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “কফি নিয়ে ওই কোণায় চলুন, তারপর বলছি।”
কফির কাপ নিয়ে এক কোনায় এসে দাঁড়ালাম। তিনিও লোকজনের ভিড় থেকে বের হয়ে কফি হাতে চলে এলেন।

“আমার প্রতিষ্ঠানের এই ব্যবসার শুরুটা একজন শ্রীলংকানের হাতে করা।” তিনি বলতে শুরু করলেন তার নতুন ভারতীয় নিয়োগ দেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির গল্প ।

“আমার টাকা ছিল, এরকম কিছুর হালকা একটা কনসেপ্ট ছিল, কিন্তু কিভাবে করা যায় সে ধারণা ছিল না। কী করা যায় ভাবছিলাম। এই সময়ে খোঁজ পেলাম সেই শ্রীলংকান ভদ্রলোকের। তার সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যপারটিতে তার অসামান্য দখল আর জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম। তাকেই দায়িত্ব দিলাম এটি দাঁড় করানোর। তিনি কী চমৎকারভাবে শূন্য থেকে এটিকে শক্তভাবে দাঁড় করেছিলেন তা আপনারা সবাই জানেন।  ৪ বছর পর ভদ্রলোক দেশে ফিরে যাবেন গোঁ ধরলেন। আমিও ভাবলাম প্রতিষ্ঠান যখন দাঁড়িয়েই গেছে, এবার একজন দেশীয় লোক দিয়ে চালাই। নিলাম একজনকে, মার্কেটে যার সুনাম কম নেই, প্যাকেজ ওই শ্রীলংকানের চেয়ে বেশি দিয়েই। তিনি এসে দেড় বছরেই আমার প্রতিষ্ঠানের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়লেন! মুখে যে যত কথাই বলুক তার আসল দৌড় বুঝে গেলাম। টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে রিলিজ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাবলাম একবার ভুল হতেই পারে। আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক। আরেকজন এদেশীয় নিয়োগ দিলাম। এবারে আরও বেশি টাকা দিলাম তার সুনামের কথা ভেবেই। তিনি ২ বছরে এমন অবস্থা করলেন যে, আমার সেই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো অবস্থা! যে ব্যবসা আমার ছিল ক্যাশ-কাউ, সেটি হয়ে গেল বিরাট লস-মেকার! তাড়াতাড়ি উনাকে সেপারেশনের জন্য বিরাট কম্পেসেশন দিয়ে বিদায় করলাম।”

বিজ্ঞাপন

তিনি বলে চলছেন, “বাধ্য হয়ে আবার ফিরে গেলাম দেশের বাইরে লোক খুঁজতে। এবার ভারত থেকে নিয়ে আসলাম একজনকে। প্যাকেজ গত দেশীয় ভদ্রলোকের চাইতেও কম। তিনি এসে ৩ বছর ছিলেন। আমার প্রায় ভেঙে পড়া ব্যবসাকে আবার দাঁড়া করিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছেন। সেটি আপনারাও টের পাচ্ছেন। কিছুদিন আগে তিনি যখন চলে গেলেন আমি অনেক ভেবেছি দেশের কাউকে দায়িত্বটা দেব কি না। আগের দুইবারের অভিজ্ঞতা থেকে সাহস বা ভরসা কোনটাই পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে আনতে হয়েছে, আবার।”

তিনি এবার জিজ্ঞেস করলেন, “এবার বলেন কেন আমি আমার ব্যবসাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেশীয় কর্মী নিয়োগ দেব? আমি ব্যবসা করতে এসেছি, তার জন্য পৃথিবীর যেখানে উপযুক্ত লোক পাব, যে আমার ব্যবসাকে চালাতে পারবে, তাকেই আমি নেব। এত এত টাকা দেওয়ার পরেও যদি আমি এদেশে সঠিক মানুষ না পেয়ে বাইরে থেকে লোক আনি, তার জন্য আমাকে আপনি দোষ দিতে পারেন কি?”

আসলেই, তাকে দোষ দিতে পারি কি?

আমার অবজার্ভেশন বলে, আগামী ৫-১৫ বছরে বাংলাদেশের বিজনেস সেক্টরে সবচেয়ে অভাব হবে যার তা কিন্তু উদ্যোক্তা নয়, আইডিয়া নয়, এমনকি টাকাও নয়, তা হলো মেধার। মেধাবী মানুষ বা যাকে বলে হিউম্যান রিসোর্সের।

নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন ভেবে যে দেশে শ-খানেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে হিউম্যান রিসোর্সের অভাব হয় কিভাবে? উত্তর হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা শেখানো হচ্ছে তা কি আদৌ এখনকার এবং আসছে দশকের ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগবে? যুগের প্রয়োজন মেটাতে পারবে?

খুব স্বল্পসংখ্যক কোর্স, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক বাদে আমরা গৎবাঁধা বিবিএ-এমবিএ-তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১০-১৫ বছর আগের স্লাইড দেখে পড়ি, তত্ত্বকথাও শিখি, কিন্তু যুগের সঙ্গে মিল রেখে হাতে-কলমে কিছু শিখি না । গণ্ডায় গণ্ডায় এ্যাসাইনমেন্ট-প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা দেই, কিন্তু কিভাবে আসলে বিজনেস কেস বানাতে হয় শিখি না। কয়েক ডজন প্রেজেন্টেশন দেই, কিন্তু ইন্টারভিউতে ঠিক মতো কথা বলতে পারি না, প্রেজেন্টেশন তো দূরের কথা!

আমরা তত্ত্ব শিখি, তার ব্যবহার শিখি না, তাকে রিলেট করা শিখি না, প্রয়োগ করে সমস্যা সমাধান করাটা শিখি না। বন্ধু-বড় ভাইদের কাছ থেকে এ্যাসাইনমেন্ট কপি করতে শিখি, নিজে কিভাবে সত্যিকারের সার্ভে করে, ডাটা অ্যানালাইসিস করে একটা কেস দাঁড় করানো যায় তা শিখি না। আমরা প্রেজেন্টেশনের দিনে কিভাবে স্যুটেড-বুটেড হয়ে, শাড়ি পড়ে এসে ছবি তুলতে হয় সেটি শিখি, কিন্তু প্রেজেন্টেশনের আসল টেকনিকগুলো শিখি না, প্রশ্ন করা কিংবা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শিখি না। আমরা মুখস্ত করতে শিখি, কিন্তু চিন্তা করতে শিখি না।

তার উপর আছে লোকাল কেস স্টাডির অভাব। নর্থ-আমেরিকান বইয়ে দেওয়া ওয়ালমার্টের কেস পড়ে কী হবে যদি আমি স্বপ্ন’র কেস না জানি? এম&এম-এর ডিস্ট্রিবিউশন মডেল জেনে কী হবে যদি আমি ‘প্রাণ’-এর ডিস্ট্রিবিউশন মডেল না জানি? নোকিয়ার’র ব্যর্থতার কারণ জেনে কী হবে যদি আমি ‘ইকোনো বলপেন’ বা ‘মিমি চকলেট’ কী কারণে হারিয়ে গেল সেটা না জানি? আমেরিকার ‘গট মিল্ক’ ক্যাম্পেইনের আদ্যোপান্ত জেনে কী হবে যদি আমি ‘এ্যারোমেটিক হালাল সাবান’ কিংবা ‘রাঁধুনি’র ক্যাম্পেইনের ব্যাপারে না জানি? ইন্টারনেট কোম্পানি এওএল কিভাবে পুরো আমেরিকায় সার্ভিস দেয় সেটি জেনে কী হবে যদি লিঙ্ক-থ্রি কিভাবে সারা বাংলাদেশের এতগুলো জেলায় সার্ভিস দিচ্ছে সেটি না জানি?

মার্কেটিং বলি বা বিজনেস—সবসময় যে জায়গায় হয়, সেখানকার পরিস্থিতি, সেখানকার প্রসেস-সিস্টেম-কলা কৌশল, সেখানকার জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে হয়। মার্কেটিংয়ের থিওরিগুলো সারা পৃথিবীতে এক হতে পারে কিন্তু এর প্রয়োগ সবসময়ই ভীষণভাবে স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে করতে হয়। সেটি না করতে জানলে সিজিপিএ-৪.০০ হয়েও লাভ নেই।

প্রশ্ন করতে পারেন আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কখনই চমৎকার আধুনিক কিছু ছিল না, তাহলে আরও আগে এই সংকট হয়নি কেন? এর কারণ আছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সবসময়ই মুখস্তবিদ্যা আর তথ্যকেন্দ্রিক ছিল, তারপরও হিউম্যান রিসোর্সের এই সংকটটা আগে এভাবে আসেনি—কারণ, আগেকার সময়টা বিশ্বায়নের যুগ ছিল না।

একটা উদাহরণ দেই। ধরুন আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে এদেশে ফেসক্রিম ছিল মূলত দু’টি—‘তিব্বত’ আর ‘কিউট’। খুঁজলে দেখবেন এই দু’টোরই ব্র্যান্ড ম্যানেজার বা বিজনেস ম্যানেজার হিসেবে যারা ছিলেন তারা এদেশেরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। তাদের পড়াশোনার ধরণ-ধারণ, শিক্ষা সবই একই ধাঁচের। সুতরাং কম্পিটিশনে তাদের দু’জনের যোগ্যতাও একই মাপের, একই মানের। বাজারে যেহেতু আর তেমন কেউ নেই সুতরাং তাদের প্রতিযোগিতা হচ্ছিলো একের সঙ্গে অপরের।

কিন্তু এই সুখের সময় বেশিদিন রইল না। আস্তে আস্তে বিশ্বব্যবস্থা বদলাতে শুরু করল, বাংলাদেশও প্রবেশ করল উন্মুক্ত অর্থনীতির যুগে। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আর ব্র্যান্ডগুলো এদেশের বাজারে আসা শুরু করল। প্রতিযোগিতাটা আর তিব্বত বনাম কিউট-এর ভেতর রইল না। প্রতিযোগী হিসেবে দৌড়ে নাম লেখালো ব্রিটেনের ইউনিলিভার, জার্মানির নেভিয়া, আমেরিকার পি&জি, ফ্রান্সের এল’ওরেল এরকম সব বাঘা বাঘা জায়েন্টরা! মেধা, কৌশল আর এফিসিয়েন্সির প্রতিযোগিতাটা আর কিন্তু ওই দুই দেশীয় কোম্পানির ব্র্যান্ড ম্যানেজারের মধ্যে রইল না। বরং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বের হয়েও তাদের পড়তে হলো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়। তাদের লড়াইটা শুরু হলো অক্সফোর্ড, মিউনিখ-হেইডেলবার্গ-বন, বোস্টন-হার্ভাড, INSEAD-HEC প্যারিস থেকে বের হয়ে আসা গ্রাজুয়েটদের সঙ্গে। মেধার পার্থক্যটা আর শিক্ষাব্যবস্থার বিশাল ফাঁকটা ধরা পড়া শুরু করল ঠিক তখনই! আর দেশীয় ব্যবসায় মেধার সংকটটাও শুরু হলো তখন থেকেই।

ডেনমার্কে দেখেছি আমাদের আরলার গরুর ফার্মগুলোতে গরুর খাবার থেকে শুরু করে যত্নআত্তি সব কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে আর শিক্ষকরা। ফার্মে নতুন মেশিন-টেকনোলজি লাগবে, খবর দাও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। নতুন আবহাওয়া আর স্পেসের ক্যালকুলেশন লাগবে, খবর দাও স্ট্যাটিস্টিক ডিপার্টমেন্টকে। দুধের কোয়ালিটি নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, খবর দাও বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টকে। নতুন প্রোডাক্ট বানানোর জন্য গবেষণা লাগবে, ডেকে আনো ফুড-সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েদের। এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে নামার আগে পড়াশোনা করার সময়ই ওখানকার ছেলেমেয়েরা একেকজন কত বাস্তব জ্ঞান নিয়ে ফেলে! এর ফলে এরা যখন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়, একেকজন যেন একেকটা ছোটখাটো বাঘ।

আরলা’তে ‘ফিউচার১৫’ নামে একটা কনসেপ্ট আছে, সংক্ষেপে আমরা বলি ‘এফফিফটিন’। সারা পৃথিবী থেকে ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবছর মাত্র ১৫ জনকে বেছে নেওয়া হয়, যাদের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ফাংশনে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করানোর মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় আরলা‘র ভবিষ্যৎ লিডার হিসেবে। গেল ৫ বছরে এরকম ৫ জন আমার সঙ্গে কাজ করেছে—সুইডিশ, ডাচ, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড আর ব্রিটেনের ছেলেমেয়ে তারা। প্রত্যেকে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্রেশ গ্রাজুয়েট হয়ে এসেছে ৬ মাসও হয়নি। অথচ কী তীক্ষ্ণ একেকজন! কী পরিষ্কার কনসেপ্ট, কী প্র্যাকটিক্যাল ধারণা, পরিশ্রমী আর ডেডিকেটেড! ১৬ বছর পাড়ি দিয়ে আসার পরও ওদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলে মাঝে মাঝে আমারও খাবি খেতে হয়! মাঝে মাঝে ভাবি—কবে আমাদের গ্রাজুয়েটরা এরকম একেকটা বাঘ হয়ে উঠবে! তবে দোষ আমাদের ছেলেমেয়েদের নয়। দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যা নোট মুখস্থ, অ্যাসাইনমেন্ট কপি আর সিজিপি-এ’র পেছনে দৌড় শেখায়, কিন্তু লজিক্যাল ডিডাকশন, প্র্যাকটিক্যাল কাজ, ইন-ডেপথ চিন্তা করা শেখায় না। ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেতে শেখায় কিন্তু সত্যিকারের ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করতে শেখায় না।

বলতে পারেন সবাই একরকম নয়। আমিও বলি অবশ্যই সবাই একরকম নয়। এই বিধ্বংসী শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁক গলে যে কজন প্রচণ্ড মেধা আর নিজ চেষ্টায় নিজেদের তৈরি করে নেয়, তাদের অধ্যবসায় আর প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিকে সালাম না জানিয়ে পারা যায় না। কিন্তু সেই সংখ্যা নগন্য। সেই সামান্য ক’জন যথেষ্ট ছিল—যখন এদেশের ব্যবসাক্ষেত্র খুব ছোট ছিল, ছিল হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র কোম্পানি, ব্যাংক, সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু এখনকার সময়ে যখন বাংলাদেশের ব্যবসাক্ষেত্র তর তর করে বাড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে, প্রতিযোগিতায় নামছে আন্তর্জাতিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, তখন এই সংখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলাফল হিসেবে আমরা এখন ভালো হিউম্যান রিসোর্সের এই তীব্র সংকট দেখছি।

একটি প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুর পেছনেই কিন্তু থাকে মানুষের মেধা, আন্তরিকতা আর পরিশ্রম। সমস্যা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মেধানির্ভর নয়, স্মৃতিশক্তি নির্ভর। আমাদের সমাজব্যবস্থা আন্তরিকতা না শিখিয়ে ফাঁকি দেওয়া শেখায়। আমাদের মানসিকতা পরিশ্রম না করে শর্টকাটে আগানোতে বেশি আগ্রহী। এই শিক্ষা আর মানসিকতা নিয়ে আর যাইহোক বৈশ্বিক লেভেলে প্রতিযোগিতায় নামা যায় না। ফলাফল যুদ্ধের মাঠে আমরা সহজেই পরাজিত হই। হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এই সংকটের আরেকটি কারণ হচ্ছে বিসিএস প্রীতি। কিছুদিন আগে দেশের বিখ্যাত এবং অন্যতম পুরানো এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন “ছেলেমেয়েরা পড়ার বই আর পড়ে না। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই শুরু করে বিসিএস পড়া। এদের টেবিলে পড়ার বই থাকে না, থাকে শুধু বিসিএস গাইড।” বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির প্রতি এই যে অন্ধ মোহ, তার কারণে গ্রাজুয়েটদের একটা বিরাট অংশের একাডেমিক পড়াশোনায় বিরাট ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। বিসিএস কেন এত মোহময়? চাকরির নিশ্চয়তার জন্য তো, যেটি প্রাইভেট চাকরিতে কম? আমি বলব সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আপনার পারফর্মেন্স যদি ভালো হয়, আপনি যদি বিজনেস অবজেক্টিভ ডেলিভারি করেন, তবে যে কোনো প্রাইভেট কোম্পানি আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে। আপনি সেখানকার রাজা। বস্তুত, আপনি শুধু সেই কোম্পানির রাজাই থাকবেন না, বরং অসংখ্য কোম্পানি আপনাকে নিতে প্রতিযোগিতায় নামবে। সৎ পথে আপনি অবিশ্বাস্য অংকের টাকা আয় করতে পারবেন, সাথে সম্মান আর দেশের উন্নতিতে অবদান রাখার সুযোগ। তারপরও দেখি বিসিএসের মোহে ছেলেমেয়েরা আসল পড়াশোনা আর জ্ঞান নেওয়াটা ভুলে যায়। বিসিএস গাইডে আটকে থেকে নিজেদের সাবজেক্টের তেমন কিছু না জেনেই কোনোরকমে এরা গ্রাজুয়েট হয়ে আসে। তারপর যদি বিসিএসে চান্স না পায়, তখন না থাকে এপার, না থাকে ওপার! চাকরির বাজারে এরা সবচেয়ে অপাংক্তেয়! এমনকি আমার পরিচিত এক ফার্স্টবয়কে বিসিএসে চান্স না পেয়ে আত্মহত্যাও করতে দেখেছি! মেধার কী চরম অপব্যয়!

সংকটের শেষ কারণটি হচ্ছে মাইগ্রেশন। মাইগ্রেশনের দিক থেকে বাংলাদেশের কেস খুবই অদ্ভুত! যুদ্ধ কিংবা দুর্ভিক্ষ না ঘটলে সারা পৃথিবীতে সাধারণত মাইগ্রেট করে ভাগ্য-বিতাড়িত মানুষ। অর্থাৎ যারা দেশে ভালো আয়ের ব্যবস্থা করতে পারে না তারা ভিন্ন দেশে গিয়ে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টো। এদেশের মাইগ্রেশনের হার উচ্চবিত্তদের ভেতর সবচেয়ে বেশি। এদেশে মাইগ্রেট করে সবচেয়ে ভালো মেধাবীরা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় গেল ১০ বছরে যতজন প্রফেশনাল লোককে অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা’য় মাইগ্রেট করতে দেখেছি, তারা প্রত্যেকে প্রচণ্ড চৌকস ছিলেন। এরা একেকজন একেকটি ডিপার্টমেন্টের কিংবা ব্যবসার খোলনলচে বদলে ফেলার মতো যোগ্যতা রাখতেন, কিন্তু আফসোস! আস্তে আস্তে সবাই-ই চলে গেলেন এবং যাচ্ছেন।

একটি ছোট্ট ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান দেই। প্রায় ১২ বছর আগে আমি মনে মনে ৬ জন তরুণ মার্কেটিয়ারকে টার্গেট করেছিলাম যে এরা ক্যারিয়ারে দারুণ ভালো করবেন। সেই ৬ জন উঠছিলেনও ঝড়ের মতো দারুণ সুনাম নিয়ে। কাজ করছিলেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ভালো ভালো পদে। কিন্তু দুঃখের সাথে খেয়াল করলাম, প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় এই ৬ জনের ভেতর ৫ জনই ইতিমধ্যে মাইগ্রেশন নিয়ে চলে গেছেন! আর একজন মাত্র বাকি আছেন। ভাবেসাবে বুঝছি তিনিও চলে যাবেন!

দিনে দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতি যত উন্নতি হবে, বৈশ্বিকভাবে দেশ যত এগিয়ে যাবে, মেধার এই সংকট তত বাড়বে।

তাহলে এই যে দেশে ১০০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন তৈরি হচ্ছে, চীন-জাপান-ইউরোপ থেকে এত এত বিনিয়োগ আসছে, সেগুলোতে কাজ করবেন কারা? কারা চালাবেন এত এত প্রতিষ্ঠান? উপযুক্ত লোক কই? ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। এই নতুন বাংলাদেশের ব্যবসাক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো চৌকস মেধা কোথায়? দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে তর তর করে বড় হচ্ছে, বিশ্ববাজারে ঢুকছে, তাদের হয়ে বিশ্ববাজারে যুদ্ধটা করবে কারা?

ব্যক্তিগতভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অনুরোধ পাই লোক খুঁজে দেওয়ার জন্য। ফেসবুকে আর লিংডইনে কানেকশনের অভাব নেই, কিন্তু রেফার করতে গেলে ১০ টা নাম খুঁজে পাই না, যাদেরকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রেফার করা যায়। অন্তত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জানি যারা কয়েক লাখ টাকা আর গাড়ির অফার নিয়ে প্রায় ২ বছর বসে থেকে তারপর মিড-লেভেলে লোক খুঁজে পেয়েছে, কেউ কেউ এখনও পায়নি। আর টপ-লেভেলের কথা নাই বা বললাম! নিদারুণ হাহাকার যাকে বলে।

ফলাফল হিসেবে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ হাত বাড়াচ্ছেন বাইরের দিকে। লোক আনছেন ভারত, শ্রীলংকা, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, হংকং, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া এমনকি রাশিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার মতো দূর দূরান্ত থেকে। অন্যদিকে আমাদের দেশের লাখ লাখ গ্রাজুয়েট মাত্র ২০ হাজার টাকার একটা চাকরি পাওয়ার জন্য হাহাকার করে মরছে!

হয়ত বলবেন দেশের লোককে কাজ দেওয়া উনাদের দেশপ্রেমের দায়িত্বের ভেতর পড়ে। আমি বলব “মোটেও নয়।” উনারা উদ্যোক্তা । আমলাতন্ত্রের জটিলতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, পলিসিগত শূণ্যতা এত সব কিছু পায়ে ঠেলে উনারা যখন উনাদের টাকা-মেধা-সময় এদেশে বিনিয়োগ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনই দেশপ্রেমের যথেষ্ট প্রকাশ এবং প্রমাণ উনারা দিয়ে ফেলেছেন। বিশ্বায়নের এযুগে যে কোনো উদ্যোক্তা তার মেধা-অর্থ-সময় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বিনিয়োগ করার স্বাধীনতা এবং অধিকার রাখেন। তারপরও অন্য কোথাও না গিয়ে তিনি বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন তার বিনিয়োগের জন্য। তার কাছে আমরা আর কত দেশপ্রেম চাই? তাকে ঠিকঠাক মতো হিউম্যান রিসোর্স যোগান দেওয়াটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব ছিল, সেটি যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে পারে তবে বিদেশি লোককে বেছে নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাকে মোটেই দোষ দেওয়া যায় না। তার ব্যবসা নিশ্চয়ই তিনি দেশপ্রেম দেখানোর জন্য লাটে উঠাবেন না। দেশপ্রেম দেখিয়ে দেশি কিন্তু অযোগ্য লোককে কাজে নিয়োগ করে ব্যবসার বারোটা বাজালে দেশের কোনো উপকারও নিশ্চয়ই হবে না, উল্টো বরং ক্ষতিই হবে।

হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া, তাদের আরও চৌকস করে নেওয়া প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের ভেতর নিশ্চয়ই পড়ে। কিন্তু তার আগে তাকে ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন লোক তো পেতে হবে, যাকে ট্রেনিং দিয়ে আরও ভালোমতো তৈরি করে নেওয়া যায়। সেটি না পেলে তিনি নিশ্চয়ই শূন্য থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন না। মনে রাখতে হবে উদ্যোক্তা এখানে ব্যবসা করতে এসেছেন, স্কুল খুলতে নয়।

আরেক প্রতিষ্ঠানের এক মালিক কথায় কথায় আমাকে একদিন বলেছিলেন— “আমি ৫ পেলে তাকে ৮ কিংবা ১০ বানাতে ইনভেস্ট করতে পারি, কিন্তু ০ বা ১ পেলে তাকে কিভাবে ৮-১০ বানাবো? কেনই বা বানাবো?”

তাই যা বলছিলাম। আমার পর্যবেক্ষণ বলে, ভালো জনবল তৈরি না হওয়া এবং ভালোদের মাইগ্রেট করে চলে যাওয়া এই দুই সমস্যা মিলিয়ে সামনের এক যুগে বাংলাদেশের ব্যবসাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দেবে ভালো মানের চৌকস হিউম্যান রিসোর্সের অভাব। ফলাফল হিসেবে দুটো বিষয় ঘটবে—

১) দেশীয় উদ্যোগ মার খাবে— উদ্যোক্তাগণ ক্ষতির মুখে পড়বেন। সঙ্গে ব্যাংকিং খাত এবং সামগ্রিক অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে।
২) উদ্যোক্তাগণ দিনে দিনে আরও বেশি বিদেশী কর্মীবাহিনীর উপর নির্ভর করা শুরু করবেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে আমাদের দেশের মিড থেকে টপ লেয়ার পর্যন্ত বিদেশি লোকে ভেসে যাবে। অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সুফলের একটা বড় অংশই নিয়ে যাবেন বিদেশি কর্মীরা। কী আফসোস!

এর সমাধান কী?

আমি কোনো শিক্ষাবিদ নই। পলিসি মেকারও নই। আমি সামান্য একজন চাকরিজীবী মাত্র। তাই “শিক্ষাব্যবস্থা বদলাতে হবে” এই সব গালভরা বুলি দেব না। দিয়েও কোনো লাভ নেই। শিক্ষাব্যবস্থা বদলানোর এই কথা গেল কয়েকযুগ ধরে বহু বড় বড় শিক্ষাবিদ বলে এসেছেন, তাতে লাভ হয়নি কিছু। দিনশেষে রয়ে গিয়েছে সেই খাড়া-বড়ি-থোর, থোর-বড়ি-খাড়াই।

আমার মতামতটা ভিন্ন। শিক্ষাব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না থেকে নিজের শিক্ষার ভারটা নিজের হাতে নিন। বিশেষত যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন কোর্সের বাইরে পড়া শুরু করুন, জানা শুরু করুন। বই ছাড়াও জানার আরও অনেক সোর্স এখন আছে। ইউটিউব, কেস ম্যাটারিয়াল, ডকুমেন্টারি, পডকাস্ট ইত্যাদি দেখুন, শুনুন, পড়ুন, পড়ুন এবং পড়ুন। সিজিপিএ নিয়ে গর্ব করা বাদ দিন, কারণ আপনার প্রতিযোগিতা আপনার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নয়, বরং হার্ভার্ড-অক্সফোর্ড বিজনেস স্কুল থেকে পড়ে আসা লোকদের সঙ্গে। সিজিপিএ যাই থাকুক কাজ করতে গিয়ে আমেরিকা-ইউরোপ-ভারত-চীন-সাউথ ইস্ট এশিয়ার ওই সব বাঘা বাঘা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবেন তো? না পারলে আপনার আকাশচুম্বী সিজিপিএ আর ফাইলভর্তি সার্টিফিকেটের কাগজ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কোনো লাভ নেই। প্রতিষ্ঠান বেতন দেয় কর্মীর কাজকে, তার একাডেমিক রেকর্ডকে নয়। আপনার যাবতীয় রেজাল্ট আর সিজিপিএ’র কাজ আপনাকে প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ করে ইন্টারভিউতে ডাক এনে দেওয়া। ইন্টারভিউর দরজা দিয়ে ঢোকা মাত্র আপনার নিজস্ব সত্যিকারের জ্ঞান, চিন্তাশক্তি, অ্যাটিটিউড, কমিউনিকেশন স্কিল, পেশাদারিত্ব, ডেডিকেশন আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কত সিজিপিএ নিয়ে এসেছেন তা তখন গৌণ মাত্র। তেতো শোনালেও এটাই বাস্তব কথা।

যারা প্রফেশনাল লাইফের শুরুর দিকে আছেন, তারা দয়া করে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখুন। আপনি যদি দু-বছর আগেও পড়াশোনা শেষ করে প্রফেশনাল ফিল্ডে এসে থাকেন, তার মানে আপনি যা যা পড়াশোনা করে বিশাল রেজাল্ট নিয়ে এসেছেন, তা ইতিমধ্যেই দু-বছর পুরনো হয়ে গিয়েছে। এই দুই বছরে পৃথিবী বদলে গেছে অনেক। আপনি যদি সেই বদলটুকু নিজের ভেতর না নিতে পারেন, তবে আপনি ইতিমধ্যেই পিছিয়ে দুই বছর পিছিয়ে পড়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলি— আমি নর্থসাউথ থেকে গ্রাজুয়েশন করে বের হই ২০০৪ সালে। তখন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টগ্রাম কিছুই ছিল না। আর ডিজিটাল মার্কেটিং শব্দটা তো তখনও তৈরিই হয়নি। অথচ এখন আমার মার্কেটিং প্ল্যানের একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে এই বিষয়গুলো। প্রতিদিন আমাকে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। আমি যদি নিজেকে সময়ের সঙ্গে আপডেট না করতে পারতাম, তবে আমি ইতিমধ্যেই মার্কেটিংয়ের যুদ্ধের মাঠের বাইরে ছিটকে যেতাম। প্রতিটি প্রফেশনাল ব্যক্তিকে এটা মনে রাখা জরুরি যে, মেধাকেন্দ্রীক যুদ্ধের এই মাঠে প্রতিনিয়ত নিজের অস্ত্রকে অর্থাৎ নিজের মেধা-জ্ঞানকে ধারালো রাখতে হবে।

এখন অনেক ধরণের ট্রেনিং হয়, প্রফেশনাল কোর্স হয়। সেগুলোতে অংশ নিন— না, সেলফি তোলার জন্য নয়, সত্যিকার কিছু শেখার জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে প্রফেশনালদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। কিন্তু তাদের কাছে শুধু চাকরির অনুরোধ না করে বরং দরকার হলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কোনো সত্যিকারের প্রজেক্টে কাজ করুন। যা শিখবেন তা চাকরির চেয়েও বেশি কাজে দেবে। অনলাইনে অনেক চমৎকার চমৎকার কোর্স আছে, মডিউল আছে, সেগুলো পড়ুন, অংশ নিন। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লেটেস্ট মডেলের মোবাইল না কিনে টাকাটা বরং ট্রেনিং, কোর্স আর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের জন্য খরচ করুন। একসময় প্রতি বছর ১ লাখ টাকার মোবাইল কিনতে পারবেন। বন্ধুদের সাথে হ্যাংআউটে গিয়ে ২০০০ টাকা খরচ না করে, ১০০০ টাকা খরচ করে ভালো ভালো সেমিনারে যান। দেখবেন কাজে লাগবে, কিছু নতুন শিখতে পারবেন, না হলেও দুই জন নতুন কানেকশন বাড়বে। এর মূল্য কিন্তু কম নয়।

মেধা আর উপযুক্ত লোকের এই সংকটের অন্য একটি দিক হচ্ছে মেধাবী আর যোগ্যদের জন্য অবারিত সুযোগ। ভেবে দেখুন বুমিং ইকোনমির এই দেশে যদি উপযুক্ত লোকের সংকট থাকে এবং বাড়ে, তবে যে কয়জন লোক যোগ্য আছেন বা হবেন, তাদের চাহিদা কত বেশি হবে! সোনার ডিমের পাড়া হাঁসের মতো সেই লোকগুলোকে নিয়ে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ কাড়াকাড়ি করবে! আপনি যদি সেরকম একজন হতে পারেন, তবে প্রফেশনাল জীবনে আর কী চাই আপনার? সুতরাং এই সংকট কিন্তু আপনার জন্য এক দারুণ সুযোগও বটে, যদি আপনি নিজেকে তৈরি করতে পারেন।

আমাদের একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর ভরসা করে বা তাকে দোষ দিলে আপনার লাভের লাভ কিছুই হবে না। দিনশেষে আপনার জীবনের, আপনার ক্যারিয়ারের যুদ্ধটা আপনাকে একাই করতে হবে। মেধার সংকটের এই দেশে আপনি এই দারুণ সুযোগটি হেলায় হারাবেন, নাকি নিজেকে প্রস্তুত করে দু-হাতে এই সংকটের লাভ তুলে নেবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনার। পৃথিবী আপনার জন্য থেমে থাকবে না, কখনও কারও জন্য থাকেনি। হয় আপনি, না হয় অন্য কেউ—প্রতিষ্ঠান তার প্রয়োজন অনুযায়ী লোক ঠিকই বেছে নেবে। দেশ-ধর্ম-অঞ্চল-ভাষা কোনোটাই তাকে আটকাতে পারবে না। সেই লোকটা কী আপনি হবেন, নাকি অন্য কেউ—তা একান্তই আপনার যোগ্যতার উপর নির্ভর করে। আর কারও নয়।

লেখক: বিপণন প্রধান, আরলা ফুডস বাংলাদেশ

আরলা ফুডস টপ নিউজ দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ শীর্ষ পদে বিদেশিরা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর