‘বিদেশি স্পাই’ তাসনিম খলিলের দেশত্যাগ নিয়ে তার নিজের লেখা ভাষ্য
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৪৪
কাতারের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত প্রচারযন্ত্র আল জাজিরায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিও থ্রিলারকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে দাবি করেছেন তাসনিম খলিল নামের এক ব্যক্তি। নেত্র নামের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রোপাপান্ডা সাইটের সাংবাদিক হিসেবে ওই ভিডিওতে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন তিনি। এর আগে, তিনি দেশের বাইরের বিভিন্ন ফোরামে দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। কিন্তু তার এই দাবি কতখানি সত্য? আসুন তথ্যপ্রমাণসহ একটু জেনে নেই, কে এই তাসনিম খলিল এবং কেনই বা তিনি দেশের বাইরে।
প্রকৃত সত্য হলো, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগেই ২০০৭ সালে দেশ ছেড়েছেন তাসনিম খলিল। এখন সরকাবিরোধী প্রচারণায় যুক্ত থেকে বিদেশে নিজের ও পরিবারের বিলাসবহুল জীবন নিশ্চিত করতেই সরকারবিরোধী নানাবিধ মিথ্যা ও গুজব ছড়াচ্ছে। তবে ইতোপূর্বে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এ দেওয়া তাসনিম খলিলের একটি সাক্ষাৎকার থেকেই তার মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। সত্য প্রকাশের স্বার্থে সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
তাসনিম খলিলের পরিচয়
২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ডেইলি স্টার পত্রিকায় চাকরি করতেন তাসনিম খলিল। এছাড়াও তিনি সিএনএন-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর একটি প্রকল্পে জড়িত ছিলেন। এসময় বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন চলছিল। তাসনিম খলিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া ইন্টারভিউতে সেনাবাহিনী নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেন। এবং নিজের ব্লগেও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আক্রমণাত্মক লেখা লিখতে থাকেন। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যাদের ব্যক্তিগত ইমেইলে ও মোবাইলে টেক্সট দিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিতেন তিনি। এর সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত বিষয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, ওই বছরের ১১ মে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে আটক করে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই। এরপর ২২ ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর দেশত্যাগ করেন তাসনিম খলিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেভাবে আটক হন তাসনিম খলিল
এবিষয়ে কয়েকমাস পর ওই ঘটনা সম্পর্কে নিজেই বিস্তারিত জানিয়েছেন তাসনিম খলিল। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সেদিন ঢাকার বাসায় নিজের বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। এমন সময় কয়েকজন লোক এসে নিজেদের যৌথ বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে আমার বাসা তল্লাশি করল। একপর্যায়ে একজন কম্পিউটারের সামনে বসলেন। সেখানে আমি একজন কূটনীতিকের কাছে ইমেইল লিখছিলাম, সেই ইমেইলটি খোলা ছিল। তিনি সেটা পড়তে শুরু করলেন। এরপর আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিস পড়তে তাকে নিষেধ করলাম এবং হুট করে কম্পিউটারের রিস্টার্ট বাটনটি চেপে দিলাম, যাতে তিনি পড়তে না পারেন। এরপর ওই লোকটি রেগে গিয়ে আমার দিকে অস্ত্র তাক করে এবং আমাকে গ্রেফতার করা হলো জানিয়ে আমার কম্পিউটার, ফোন সব জব্দ করে। এরপর আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়’।
কী লেখা ছিল সেই ইমেইলে, যার কারণে এতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল যৌথবাহিনীর পরিচয় দেওয়া সেই লোকগুলো। এ বিষয়ে তাসনিম খলিল নিজেই নিখেছেন, ‘র্যাব নিয়ে লেখালেখির কারণে ওরা ক্ষুব্ধ ছিল। আসলে এর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ডিজিএফআই-এর একজন অফিসার আমাকে ফোন দিয়ে শাসাচ্ছিলেন। আমি এতে কিছুটা ভীত ছিলাম। তারা আমাকে দেখা করতেও ডেকেছিলেন। কিন্তু আমি ভয়ে যাইনি। তবে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমি একজন বিদেশি কূটনীতিককে ইমেইল লিখছিলাম। ওই কূটনীতিক এর আগে আমার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাই আমি তাকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে ইমেইলটি লিখছিলাম। সেখানে সেনাবাহিনী, র্যাব, যৌথবাহিনী, প্রভৃতি সার্বিক বিষয়ে লেখা ছিল। বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ ও ব্লগে লেখালেখির কারণে একজন লে. কর্নেল যে আমাকে দেখা করতে ডাকছেন, সে বিষয়েও লেখা ছিল। কিন্তু মেইলটি তখনও শেষ হয়নি। অর্ধেক ড্রাফট হয়েছিল। এ কারণে মেইলটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে খোলা অবস্থাতেই ছিল’।
যে কারণে গোয়েন্দারা আটক করেছিল তাকে
আটকের ব্যাপারে তাসনিম খলিল লিখেছিলেন, ‘তারা আমাকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর একটি রুমে নিয়ে আমার মেডিক্যাল চেকআপ করানো হয়। তারপর আরেকটি রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেই সময়ে আমি সিএনএন-এ কী কী রিপোর্ট করেছি, সেগুলোর ব্যাপারে জানতে চায় তারা। তবে ওই ভীতিকর পরিস্থিতিতে আমি তা মনে করতে পারিনি। তখন তাদের একজন চিৎকার করে গালি দেয় এবং বলে যে, ‘তুমি এতো বছর ধরে সিএনএন-এ যা রিপোর্ট করেছো সবই নেগেটিভ, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো কিছু লিখোনি কখনো। সবসময় বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছো বিশ্বের বুকে। তুমি একজন বিদেশি এজেন্ট। রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে তুমি দেশকে সবসময় ছোট করো—এসব বলার পর তারা আমাকে মারতে থাকে’।
জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে খলিল আরও লেখেন, ‘এরপর তাদের একজন আমার কাছে জানতে চায়, এর আগে মে মাসের ২ তারিখে ডিজিএফআই-এর হেডকোয়ার্টারে ডাকার পরেও আমি যাইনি কেনে। তখন আমি তাদের জানাই—আমার ডেইলি স্টারের সম্পাদকের নিষেধ আছে— তাকে না জানিয়ে কোনো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না। এরপর বিভিন্ন কথার এক পর্যায়ে তারা আমার বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে জাতে চায়। তখন আমি জানাই, আমার বয়স ২৬ এবং আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স করেছি। তখন তারা উচ্চশব্দে হাসে এবং বলে যে—তুমি তো জার্নালিজমেই পড়োনি, সাংবাদিকতার স-ও জানো না, আবার নিজেকে সাংবাদিকতা ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন মনে করো। তুমি যেই প্লেটে খাও, সেই প্লেটেই টয়লেট করো। তুমি খুব খারাপ। পিচ্চি হান্নানের মতো সন্ত্রাসীদের শেষ করে দেওয়া কী র্যাবের খারাপ কাজ? তোমার মধ্যে দেশপ্রেম নেই। তুমি এই সমাজের শত্রু, তুমি বিদেশি এজেন্ট’।
তাসনিম খলিল আরও লেখে, ‘এক পর্যায়ে আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি দেখলাম, তারা আমার ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কেও জানে। এরপর তারা আমাকে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে বিশ্বের অনেক দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। তারা আমাকে বাঁচাতে আসবে কি-না জানতে চায় জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। এরমধ্যেই আমার স্ত্রীর মাধ্যমে আমার আটকের খবর সিএনএন, ডেইলিস্টার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানতে পারে। সিএনএন বাংলাদেশের একজন সরকারি কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জানায়, হিউম্যান রাইটস আমাকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রেস রিলিজ দেয়। এসব কারণে আমাকে দ্রুতই ছেড়ে দেওয়া হয়। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহাফুজ আনামের বাসার সামনে নামায় তারা। পরে মাহাফুজ আনাম আমাকে জানান, আমার ব্লগে লেখালেখি এবং মেইল ও মোবাইল চেক করে তারা কিছু তথ্য পেয়েছে, বিভিন্ন স্থানে (বিদেশি ব্যক্তিদের) কিছু মেসেজ (ইমেইল ও মোবাইল টেক্সট) চালাচালির কারণে আমাকে আটক করা হয়েছিল; কিন্তু আমি ডেইলি স্টারের কর্মী হওয়ায় তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে এনেছেন’।
গোয়েন্দাদের সঙ্গে মাহাফুজ আনামের মধ্যস্থতা
কিন্তু মাহাফুজ আনামের সঙ্গে সেই লে. কর্নেলের আলোচনার পর তাসনিম খলিলকে রাত ৯টায় ডেইলি স্টার অফিসে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আবারও ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে তাকে আবারও পেটানো হয় বলে নিজের লেখায় দাবি করেছেন তাসনিম খলিল। তবে রাত ৯টার দিকে তাকে সোনারগাঁ হোটেলের সামনে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি মুক্তি পান। পরের দিন ১২ মে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এমন তথ্য ছড়ানোর দায়ে তাসনিমকে আটক করা হয়েছিল’।
২০০৭ সালে তাসনিম খলিলের দেশত্যাগ
দেশ ছাড়ার ব্যাপারে তিনি আরও লিখেছেন, ২০০৭ সালের ৬ জুন এয়ারপোর্টে যান তিনি। তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার গোয়েন্দাসংস্থা। সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়। এসময় দু’জন এসেছিলেন, তাদের একজন ব্রিগেডিয়ার এবং অন্যজন লে. কর্নেল। সেই বিগ্রেডিয়ার কর্নেলের কাছে জানতে চান, তাসনিম খলিলকে নির্যাতন করা হয়েছে কি-না, শরীরে দু’য়েকটা স্পট দেখা যাচ্ছে। জবাবে কর্নেল জানান—না স্যার, রেগুলার জিজ্ঞাসাবাদের রুটিন ওয়ার্ক করা হয়েছে, আলাদাভাবে টর্চার করা হয়নি। এরপর তাসনিম খলিলকে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু না করার জন্য অনুরোধ জানান এই দুই কর্মকর্তা। তারপরই অ্যাসাইলাম নিয়ে দেশ ছাড়েন তাসনিম খলিল।
লেখক: সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট