আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:৩৯
আল জাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন কয়েক দিন ধরে দেশের সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে। ওই টেলিভিশনে বাংলাদেশের উপর এক ঘণ্টার একটি প্রতিবেদন করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের টাইটেল, ফটোগ্রাফি, সায়েন্স ফিকশন, এনিমেশন, সাউন্ড দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট তৈরিতে আল জাজিরার চমৎকারিত্ব কতই না অগ্রসর। শর্ট ফিল্মের আদলে তৈরি করা ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টের কাছে ভারতের পুলিশ ফাইল ক্রাইম পেট্রোল কিংবা সিআইডি একেবারেই নস্যি।
আবার এ প্রশ্নও জেগেছে, বুদাপেস্ট, ঢাকা কুয়ালালামপুর সিঙ্গাপুর প্যারিসে এই ছবির চিত্র ধারণ, অডিও ভিডিও এন্ড পেপার ডকুমেন্ট তৈরি, এক্সপার্ট মুভমেন্ট, বিমান ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, ফুড, একোমোডেশন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, তাসনীম খলিল, ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিশ্লেষক গ্রাহাম ব্যারো, প্রাইভেসি এক্সপার্ট ইলিয়ট বেন্ডোনেলি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড এডামসের পারিশ্রমিক মিলিয়ে কম করে হলেও খরচ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনটি দেখার পর মনে হলো একজন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য আল জাজিরা এত টাকা খরচ করবে কেন?
‘কেন’ এর উত্তর খুঁজতে সারারাত জেগে রিপোর্টটির পোস্টমর্টেম করেছি আমি আব্দুল বারী। উপস্থাপিত সকল অডিও-ভিডিও স্টিল পিকচার ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছি। বিশ্লেষণ করার পর আরও একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে আমার মনে। তা হলো এই যে, একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে এমন প্রতিবেদন তৈরি বা প্রচার করবে কেন? নিজস্ব রিপোর্ট হলে এর ব্যাপ্তি হতো বড়জোর ২০ মিনিট। তারা তো এনিমেশন দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে না। তাহলে কেন এক ঘণ্টার প্রতিবেদন। তবে কি কেউ স্লট ভাড়া নিয়ে এই অনুষ্ঠান প্রচার করেছে? এই বিষয়টি পরিষ্কার হলো তখন, যখন দেখলাম রিপোর্টের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে দক্ষ হাতের সূক্ষ্ম চাতুর্য।
যেমন প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতা নেই। আগের ঘটনা পরে। পরের ঘটনা আগে এনে সময় তারিখ ও ঘটনা সম্পর্ক বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। প্রথমেই লেখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর লোক মোহাম্মদ হাসান। কিন্তু প্রতিবেদনের কোথাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হারিসের সংশ্লিষ্টতা দেখাতে পারেননি। আর্মি চিফের সঙ্গে সরাসরি কোনো কথা বলেছেন কিংবা কোন কোন কাজ করে নিচ্ছেন এমন সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়নি। বরং হারিসের বক্তব্যে বারবার বলা হয়েছে, ‘আমি আর্মি চিফের ভাই। আমি কেন খাঁকির মইধ্যে যামু’।
প্রতিবেদনের প্রথমেই ২ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের উপস্থাপনায় বলা হয়েছে আহমেদ পরিবার একটি ক্রিমিনাল ফ্যামিলি। তাদের তিন ভাই একটা খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাদের এক ভাই প্রধানমন্ত্রীর বডিগার্ড। ১৯৯৬ সালে মোস্তাফিজুর খুনের পর তাদের কাউকেও প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক দিনও দেখা যায়নি। তাসনীম খলিলের কথায়ও তা প্রকাশ পেয়েছে। তাদের যোগসাজশে ইসরাইলের কাছ থেকে স্পাই ওয়্যার কিনেছে। প্রতিবেদনে সামীর বক্তব্যে এসেছে এই কাজের জন্য হারিসকে দিয়ে সামী ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তার কাছে তদবির করিয়েছিলেন। সেই তদবির কাজে লাগেনি। কাজটি পেয়েছেন জেমস মেলোনি নামের এক আইরিশ ব্যবসায়ী।
এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, আহমেদ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াদুদ আহমেদ ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য। বিমান ও নৌ বাহিনীতে মেধাবী ছাড়া কেউ যেতে পারেন না। সেই হিসেবে তাদের বাবার আগমন কোনো গুণ্ডাপাণ্ডার ঘর থেকে হয়নি। তারা বহু আগ থেকেই মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জেনারেল আজিজ মোহাম্মদপুর গভ: কলেজ থেকে এসএসসি, নটরডেম থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮০ সালে টেক্সটাইল ডিপ্লোমা করেন।
এরপর চট্টগ্রাম মিলিটারি একাডেমিতে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স করেন। ১৯৮৩ সনে কমিশন নিয়ে আর্টিলারি রেজিমেন্টে যোগ দেন। তার অন্যান্য ভাইদের মধ্যে হারিস নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন। এরপর তিনি আওয়ামী যুবলীগে যোগ দিয়ে ৪৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়েছিলেন। জোসেফ ও টিপু ছাত্রলীগ করতেন।
একটি খুনের দায়ে তিন ভাই সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ১৯৯৯ সনে। সেই সময়েও তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। এই পরিবারের যোগসাজশে স্পাই ওয়্যার কিনেছে এবং তাদের কথায় মন্ত্রীরা নাচে। এমন দাবির পরপরই ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে চলে গেছেন সেনাপ্রধানের ট্যুর ট্রাকিংয়ে।
দেখানো হয়েছে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ সিঙ্গাপুরে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট কনফারেন্সে যোগ দিতে দেশত্যাগ করেন। বিমানে বসে ম্যাসেজ দিয়ে হাঙ্গেরিতে বসবাসকারী ছোট ভাই হারিসকে কুয়ালালামাপুরে আসতে বলেন। কুয়ালালামপুরে নেমে তিনি ম্যাসেজ দেওয়া ভাইদের অপেক্ষমাণ অবস্থায় পেয়ে গেলেন। ভাইদের নিয়ে গ্রিন চ্যানেল দিয়ে বের হয়ে দূতাবাসে গেলেন। ভাইয়েরা অন্য একটি কারে সেখানে গিয়েছিলেন।
বিশ্লেষণ: ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর যাওয়ার সময় বিমানে বসে জেনারেল আজিজ টেক্সট ম্যাসেজ দিলেন। সেই ম্যাসেজ পেয়ে হারিস বুদাপেস্ট থেকে কুয়ালালামপুরে এসে বিমানবন্দরে জেনারেল আজিজের সঙ্গে বিমানবন্দরে মিট করলেন। ফ্লাইং ডিসটেন্স কি এই ম্যাসেজ বিশ্বাস করে? গ্রিন চ্যানেল ছাড়া কি তার ভাইয়েরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে পারতেন না? জেনারেল আজিজ একটি দেশের সেনাপ্রধান। গ্রিন চ্যানেল দিয়ে ভাইদের নিয়ে বের হওয়া অপরাধ হয় কিভাবে?
কনফারেন্সে তিনি গেলেন কি না গেলেন তা ফলো না করেই অনুসন্ধানের স্ক্রিন চলে গেল বুদাপেস্ট। ফুটে উঠলো ইনভেস্টরের ইন্টারেস্ট। ব্যবসায়ী সামী বললেন, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আজিজ আহমেদ হাঙ্গেরিতে এসে তার সাহচর্য চান। দূতাবাস না থাকায় তিনি তাকে এ্যাটেন্ট করেন। এক পর্যায়ে তার ভাইকে ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ করেন।
বিশ্লেষণ: ২০১৪ সালে আজিজ বিজিবির ডিজি ছিলেন। তিনি কেন হাঙ্গেরি গিয়েছিলেন তা বলা হলো না। একজন মেজর জেনারেল রাষ্ট্রীয় সফরে হাঙ্গেরি গিয়েছেন। সে দেশের সেনাবাহিনী তার প্রোটোকল করবে এবং নিরাপত্তা দেবে এটাই স্বাভাবিক। সিভিলিয়ান সামীকে তিনি কিভাবে চিনলেন তা বলা হয়নি।
জেনারেল আজিজ হারিসের কাগজপত্র রেডি করে সামীর কাছে পাঠান। হারিস নাম বদলিয়ে মোহাম্মদ হোসেন হয়েছেন। সেই নামে এনআইডি, জন্ম, শিক্ষা সনদ এবং পাসপোর্ট করা হয়েছে। সেগুলো সত্যায়িত করেছেন দুইজন সেনা কর্মকর্তা। এর সবই দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই সনদগুলো জাল তার পক্ষে কারো বক্তব্য নেওয়া হয়নি।
আমি আব্দুল বারী মন্তব্য করছি, সেই সময়ের নন ডিজিটাল প্রেক্ষাপটে এমন জাল সার্টিফিকেট তৈরি ও তা সত্যায়িত করার জন্য সেনা কর্মকর্তার স্বাক্ষর তেমন আবশ্যক ছিল না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েছেন। এর জন্য পাসপোর্টের এডি কাজী আকরাম সহ কতজনের চাকরি গেছে তাও কারো অজানা নয়।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে সামীর মাধ্যমে ২০১৫ সালে হারিস হাঙ্গেরিতে আসে। বে অব বেঙ্গল নামে কোম্পানি খোলে। তাতে মালিক থাকেন হারিসের স্ত্রী কন্যা ও জামাই। সেই কোম্পানির বিনিয়োগে করা নিভিয়া ফ্যাশন হাউজ ছয় মাস পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একটা রেস্টুরেন্ট করে। পাঁচ মাসে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেঙ্গল হোস্টেল করে। এক বছর পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গ্রাহাম ব্যারো নামের একজন ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিশ্লেষককে এনে মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়েছে কিনা বলা হয়নি।
বিশ্লেষণ: হারিসের যদি এত ক্ষমতা থাকতো তাহলে বেঁচে থাকার জন্য এত ব্যবসা করতে যাবে কেন? সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ থাকলে পোশাক, হোটেল, হোস্টেল ব্যবসা করবে কেন? সে সময়েও তো ভাই বিজিবির প্রধান। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। এরপর আর ব্যাখ্যার অবকাশ নিশ্চয়ই রাখে না।
বলা হয়েছে হারিস পানশালায় গিয়ে মেয়েদের বেছে হোটেলে এনে পার্টি দিত। এ ব্যাপারে কেউ তার নামে মামলা করেছিল বা পুলিশ তাকে আটক করেছে তা বলা হয়নি। তাই এটা ব্যক্তির দোষ হলেও রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধী কোনো অপরাধ নয়।
হারিস রাষ্ট্রীয় ক্রয়ে মিডলম্যান হিসেবে কাজ করেন। এর প্রমাণ হিসেবে সেনাবাহিনীর জন্য গুলি কেনার একটা ড্রিলে ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই দৃশ্য দেখানো হয়েছে। একই দৃশ্যে হারিস বলছে, ‘আমি তার ভাই। আমি শো হবো না। কোথাও আমার পরিচয় দিবেন না’। তিনি ডিজিএফআইয়ের কার সাথে কথা বলেছেন তা বলা হয়নি। আবার এসব কেনাকাটা ডিজিএফআইয়ের কাজ নয়। এটা করে ডিজিডিপি।
প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হলেও হারিস প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধানের সাথে অবাধ কথা বলছেন এমন একটি দৃশ্য কোথাও নেই। এরপর দেখানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যা প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেখানো হয়েছে।
তারপর অপ্রাসঙ্গিকভাবেই আনা হয়েছে আজিজ আহমেদ পরিবারের প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে তার বাবা একজন লোয়ার লেবেল জজ ছিলেন। তার আয়ে সংসার চলতো না। ডেভিড বার্গম্যানের অনুসন্ধান যে সঠিক নয় তার প্রমাণ এই, যে আজিজ আহমেদের বাবা বিমান বাহিনীর সদস্য ছিলেন। সংসার না চললে মেঝ ছেলে কিভাবে খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। মোহাম্মদপুরে নিজস্ব আবাসন করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গ থেকে এক লাফে চলে গেলেন ২০২০ সালে। দেখালেন সেনাপ্রধান তার এক কলিগকে ফোনে বলছেন,, জাতীয় পার্টির সময় আমার ভাইয়েরা ছিলো আওয়ামী লীগের প্রাণ। তাদের অফিসে বসেই চলতো আওয়ামী লীগের কার্যক্রম।
প্রসঙ্গের ধারা কেটে চলে এলো জেনারেল আজিজের ভাই টিপু খুনের প্রসঙ্গ। টিপু কেন কিভাবে কার গুলিতে খুন হলো। সেই মামলায় কার সাজা হলো তা না বলেই চার বছর পেছনে চলে এলেন। বলা হলো ১৯৯০ সালে হারিস শেখ হাসিনার বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতেন। আবার বলা হলো হারিস মোহাম্মদপুরের সব মিটিং অর্গানাইজড করতেন। মিটিং অর্গানাইজড করা বডিগার্ডের কাজ নয় এটা ডেভিড বার্গম্যান জানেন না, তা কি মানা যায়?
এনিমেশন দিয়ে দেখানো হলো, ১৯৯৬ সালে মোস্তাফিজুর রহমানকে হারিস বাহিনী খুন করল। কিভাবে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ডাইয়িং ডিক্লেয়ারেশন দিলেন। এরপরই বলা হলো, মোস্তাফিজুর হত্যার একমাসের মধ্যেই শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। তার মানে কি এই যে, মোস্তাফিজুরকে হত্যা করেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন? যদি তা না হয় তবে কেন এই প্রসঙ্গ এলো? মোস্তাফিজুরের ভাতিজা সাথে থাকার পরও তাকে মোস্তফা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সে যাই হোক না কেন, শেখ হাসিনার সময়েই মোস্তাফিজুর রহমানের খুনের মামলায় ১৯৯৯ সালে নিম্ন আদালতে জোসেফের মৃত্যুদণ্ড, হারিস ও আনিসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এরপর জোসেফ জেলে যায়। অন্য দুই ভাই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
এই ঘটনা এখানেই শেষ না করে আবার টিম গেল বুদাপেস্ট। সামী বললেন, হারিস ভুয়া পরিচয়ে এসেছেন এবং খুনের দায়ে তার জেল হয়েছে। এটা তিনি হাঙ্গেরিয়ান পুলিশকে জানান। এরপর জেনারেল আজিজ ২০১৬ সালের ৬ মে ইমেইল করে হুমকি দিলেন।
এরপরও ২০১৯ সালে বিজনেস ট্রিপে যাওয়া হারিসকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করেন এবং তার সাথে কোলাকুলিও করেন। তাকে ৬৬ রুমের একটি হোটেল কিনে দেন। প্রতিপক্ষ কোন হোটেল সেটাও বলেন। এর মানে কী? হারিসের ব্যাপারে পুলিশকে জানানোর পর কেন তিনি হারিসের সাথে বিজনেস ডিল করলেন? তা কেন প্রতিবেদনে নেই?
২০১৫ সালে হারিসের একজন সহকারীর সাথে মিশে (ইউসুফ ভাই) তাকে দিয়ে হারিসের বিরুদ্ধে বলিয়েছেন। এই লোকটা প্রথমে বলছে ২/১ কোটি এরপর বলছে ৩০/৪০ কোটি কামিয়েছে হারিস। তিনি যখন জানেন হারিস একজন সাইকোপ্যাথ তাহলে সহজ সরল একজন কর্মচারীকে মালিকের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে বক্তব্য নেওয়া এবং তা প্রচার করা কি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিপন্থী নয়?
২০১৮ সালের কথা নিয়ে চলে গেলেন প্যারিসে। সেখানে একটা ড্রিলের ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে চায়। রহমান সাহেব নামের একজন কানাডিয়ান ব্যবসায়ী হারিসকে ব্যবহার করে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি ২০% কমিশন চেয়েছেন। সেখানেও সামী ছিল। এতে দোষের কী আছে? বিদেশী নাগরিক কোন দেশে ব্যবসা করতে এলে লোকাল পার্টনার তো চায়ই। আব্দুল বারী মনে করে এতে দোষের তো কিছু নেই।
সেই ডিল সফল হয়েছে কি-হয়নি, তা না বলেই চলে এলেন ঢাকা। তুলে ধরা হলো জেনারেল আজিজের একটা অডিও। সেই কথা কার সাথে বলা হচ্ছে তা প্রকাশ করা হয়নি।
বলা হয়েছে জেনারেল আজিজকে আর্মি চিফ করার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় তার ছোট ভাই জোসেফের সাজা মওকুফ করিয়েছেন। কাউকে ক্ষমা করা রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা। তার কাছে এমন ক্ষমা অনেকেই পেয়েছেন। এক্ষেত্রে জোসেফ কেবলমাত্র জেনারেল আজিজের ভাই নন, সে একজন ডিফেন্স পার্সনের ছেলে। এরপরও তিনি ২০ বছর জেল খেটেছেন। এমন দীর্ঘমেয়াদি কয়েদীদের সাজা মওকুফ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ক্ষমতার অবাধ ব্যবহার করেছেন। তা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। তাই এর মধ্যে তেমন কোন অন্যায় আছে একথা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনে সেনাবাহিনী ম্যাসিভ রিগিং করেছে এবং খালেদা জিয়ার কারা ভোগের দৃশ্য কী উদ্দেশ্যে করা তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার ছুটে গিয়েছেন আসল এজেন্ডায়। সামীকে দিয়ে বলানো হয়েছে বাংলাদেশের ডিজিএফআইয়ের ৪ জন কর্মকর্তা হাঙ্গেরি আসছেন। তাদের দাওয়াত দেন সামী। জানানো হয় তাদের সাথে আরও ৩ জন অতিথি থাকবেন। পরিশেষে তাদের সাথে আসেন জেমস মেলোনি নামের একজন আইরিশ। দুইজন ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা আসতে চেয়েও আসেননি।
যেটা অনুসন্ধানীতে আসেনি। সেটা প্রকাশ পেয়েছে সামীর কথায়। জেমস মেলোনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি সিঙ্গাপুরের সভরিন সিস্টেম সার্ভলেন্স ইকুইপমেন্ট কোম্পানির সেলিং এজেন্ট। তখন সামী বুঝে ফেলেছেন যে, হারিসকে দিয়ে যে ডিল তিনি করেছিলেন তা ফলপ্রসূ হয়নি। তখন তিনি তাদের কথা রেকর্ড করেন। তিনি বলেছেন ওয়্যার হাউজের বাইরে ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এসময় প্রাইভেসি এক্সপার্ট বেন্ডোনেলিকে দিয়ে স্পাই ওয়্যার কিভাবে কাজ করে সেই বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে। যা এই প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছে। এখানেই শেষ নয়। এই দৃশ্য দেখানোর সময় বায়তুল মোকাররমের একটি ছবি দিয়ে মৌলবাদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা মামলা-যোগ্য অপরাধ।
সেনাবাহিনী একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পাহারাদার। তাদের সব দলিল সিভিলিয়ানদের জন্য নন ডিসক্লোজার সাবজেক্ট। ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও তাদের কাছ থেকে কোনো সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা কৃতিত্বের দাবি রাখে বৈকি। এ ব্যাপারে কথা বলা আর সেনা বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়া অনেকটা একই রকম বিষয়।
র্যাব বা পুলিশ ব্যবহার করে হারিস তার প্রতিবেশী সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, মাত্র একজন সেলিম প্রধান নয়, এমন অপরাধে অনেকেই গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন।
থানার ওসির পোস্টিং বাণিজ্য সেনাবাহিনীর নয়। বেসামরিক লোকজন দিয়ে এই বাণিজ্য করা এদেশে অনেক পুরাণ একটা সিক্রেট ট্রেড। আনিসের ছেলের কাউন্সিলর হওয়া তাদের পুরাণ ব্যাপার। কারণ জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান হওয়ার আগেই ওই ওয়ার্ডে তার চাচা হারিস এক সময় কাউন্সিলর ছিলেন।
হারিসদের হাতে নিহত মোস্তাফিজুরের ভাতিজা হাসান মেহেদী তার প্রতিপক্ষের ক্ষমতার বিপরীতে থাকবে এটাই বাস্তবতা।
পরিশেষে হাই সোসাইটির বিয়ে উল্লেখ করে সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়ের একটা উৎসব দেখানো হয়েছে। এমন উৎসব সব দেশেই হয়। তবে এখানে যেটাকে অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে তা হলো এই যে, এমন উৎসবে পলাতক আসামী উপস্থিত ছিল।
এই প্রসঙ্গেও চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন ডেভিড বার্গম্যান। লাইভ ভিডিও চিত্রে ওই দুইজনের কাউকেও দেখা যায়নি। তবে একটি স্টিল পিকচার কয়েকবার দেখানো হয়েছে। এই ছবি যে এই বিয়ের আসর থেকে নেওয়া তার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই অনুষ্ঠানের কোনো চিত্রেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা পুলিশের আইজিকে দেখা যায়নি। সেই কারণেই প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ফিকে হয়ে গেছে।
প্রতিবেদনের শেষ হিসেবে সামীকে দিয়ে যা বলানো হয়েছে তার প্রমাণ যথাযথ হয়নি। ‘ইফ দিস রেজিম কন্টিনিউ, কান্ট্রি উইল টেক টার্ন এজ মাফিয়া স্টেটস’। এই কথার গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ এদেশে এখনো কলাম্বিয়া কিংবা পানামার মতো মাদক ব্যবসা নেই। যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা বিদেশে টিকে থাকার জন্য একটার পর একটা ব্যবসা করে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কেমন ব্যাকুল তা এই প্রতিবেদনেই আছে। তার সুপারিশে স্পাই ওয়্যারগুলো সাপ্লাই কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ যে আসেনি তাও স্পষ্ট। কোথাও তারা প্রধানমন্ত্রী তো অনেক দূরের কথা, নিজের ভাই সেনাপ্রধান কিংবা পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধান, কোনো মন্ত্রী, সচিব, বিচারপতি বা রাষ্ট্রের বড় ক্ষমতার কাছে আছেন এমন কারো সাথে সরাসরি কথা বলেছেন এমন প্রমাণ এই প্রতিবেদনে দেখা যায়নি।
কাজেই সামী তার ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে হারিসের কাছে যা আশা করেছিলেন তা পাননি। না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে কিভাবে দগ্ধ করেছে সর্বত্রই তা প্রতিবিম্বিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে ডেভিড বার্গম্যান, তাসনীম খলিল ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ নীতির চর্চা করেছেন। কান মন্ত্রের কারণেই তারা একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা একবারও বলেননি। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের আসল উদ্দেশ্য।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক