Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুজিবনগর দিবস ও শুদ্ধতার মাপকাঠি


১৭ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৩৭

বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে, মুক্তির দামামায় বিজয় কেতন উড়িয়ে সগৌরবে বাংলার জয়গান গাওয়ার দিনপঞ্জিকায় ইতিহাসের স্বর্ণালি সন্ধিক্ষণ ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগর দিবস। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে নাম সর্বস্ব পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকার ও কর্তৃত্বের কথা বলে দীর্ঘ ২৩ বছর যাবত শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট করেছে শাসকের নামে শকুনের বেশে শোষক গোষ্ঠী পাকিস্তানি হায়েনারা। পাকিস্তানি হর্তাকর্তার শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সরব প্রতিবাদের ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে নিজের কৈশোর, যৌবনের উত্তাল সময়েও কারাবাস করতে হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামে অটল থাকার কারণে তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তাদের কাছে রক্তচক্ষু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাইতো নিজের যাপিত জীবনের চৌদ্দটি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন শুধুমাত্র বাঙালি জাতির মুক্তির নেশায় বুদ হয়ে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানি শোষকেরা বাঙালিদের উপরে একের পর এক রক্ষণশীলতার চাদর আচ্ছাদনের পরেও বাঙালিরা সেই চাদর অনাবৃত করেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রয়াস চালিয়েছে। মাথা নোয়াবার ধর্ম যেন বাঙালির মজ্জায় কুক্ষিগত নেই সেই আজন্ম থেকেই। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর যখন ক্ষমতার পালাবদলের নাম করে প্রহসন আর টালবাহানায় এ জাতিকে অবরুদ্ধ করে নিঃশেষ করে দেওয়ার ফন্দিফিকির করা হয়, তখনও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ জাতীয় চার নেতা ছিলেন মুক্তির চেতনায় দ্বিধাহীন, অনড় অটল, অবিচল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই গগনবিদারী ভাষণে যেমন মুক্তির দৈববাণী নিহিত ছিল, ঠিক তেমনি সেখানে লড়াই সংগ্রামে বিজয় ছিনিয়ে আনার প্রারম্ভিক রূপকল্পের চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। কিন্তু বাঙালি লড়ে যাওয়ার খোরাক, হার না মানার রসদ পেয়েছিল সেই ৭ মার্চের ভাষণেই।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার ঘোষণার সন্ধিক্ষণ উত্তর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া পূর্বঘোষিত দিকনির্দেশনা ও রূপকল্পেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। সেই অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। জাতির পিতার অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর পদভার সামলান তাজউদ্দীন আহমদ।এছাড়াও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজনকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষধ গঠিত হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানের খবর বিশ্ববাসীকে সগৌরবে জানান দেওয়া হয়।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সরকার গঠন হবে তা অকল্পনীয় ছিল পাকিস্তানিদের কাছে। কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশ। এই অস্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই পরিকল্পিত কায়দায় মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত ও সমন্বয় সাধন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করেছিল মুজিব নগর সরকার। নবজাত রাষ্ট্রের এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় নবগঠিত এই সরকার অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। এই সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। এই সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ দ্রুততম সময়ে সফল সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। ফলস্বরূপ দীর্ঘ নয় মাস বিধ্বংসী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহিদ ও ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার জয়ধ্বনির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বাংলার ভূখণ্ড অশনি প্রেতাত্মাদের শৃঙ্খল ও পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পায়। বাংলার আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো জয় বাংলা ধ্বনি অনুরণিত হয়।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় এসেছে বিশদ আকারে অস্থিতিশীলতা। ক্রমবর্ধমান অগ্রগামী বাংলাদেশের গতিরোধ করে দেওয়া হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এরপর প্রায় দু’দশক কোনো ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। একটি সদ্য ভূমিষ্ঠ দেশের যখন জাতীয়তাবাদের শেকড় গেড়ে মৌলিক মতাদর্শ রূপায়নের বাস্তবতার দিকে ধাবিত হওয়ার কথা, সেসময়ে সংঘাত, দ্বিচারিতা, বস্তুনিষ্ঠ উন্নয়ন অপনোদনের মাধ্যমে মন্থরার গুণকীর্তন করা হয়। অন্ধের দেশে আয়না বেচার মতো রাজনৈতিক দলগুলোর ফিরিস্তি দিনকে দিন জনগণ সম্পৃক্ততা হারায়। তাদের আয়েশে খায়েশ মেটানোর রূঢ় বাস্তবতায় নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে বাংলায় আবারও দ্বিজাতিতত্ত্বের ন্যায় দ্বিদলতা ও একরোখা, একপেশে রাজনৈতিক ধারার অবগাহনে লেপ্টে বাঙালিকে এক অশনি গ্রহের দিকে নিক্ষিপ্ত করেছিল৷ যারা সে সময়ে মিথ্যা কথার পসরা বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছে, শহিদের রক্তের ঋণের কথা বলেছে তারাই, ৭১ এর অমীমাংসিত শক্তির সাথে লিয়াজু করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা গত হওয়ার পর ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিরাজনীতিকরণের জন্য ১৭ এপ্রিলের স্তুতিগাথাকে ইতিহাসের কালপঞ্জিকায় দিনক্ষণ মুছে দেওয়ার প্রবঞ্চনা দেখা গিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের এতো বছর পরেও আমরা দেখি না আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাংলাদেশের অন্যান্য সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও ন্যূনতম শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে দিনটির স্মরণে কোনো মৌখিক প্রজ্ঞাপন শুনানি করতে। এখানেই আমাদের রাজনৈতিক দীনতার পরিচয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও আমাদের যে আরও বিশদ আকারে পরিশুদ্ধ হওয়ার রয়েছে এটি খুব ভালোভাবেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও শুদ্ধত্বর বাংলাদেশ, শহিদের রক্তস্নাত ঋণের প্রতি দায়বদ্ধতার বাংলাদেশ, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আত্মশুদ্ধির রথযাত্রায় চেপে বসার সঠিক সময়টা বোধহয় এখনই।

পরিশেষে কাব্যিক ছন্দে বলতেই হয়—যতদিন বাংলার স্নিগ্ধ আকাশে মুক্ত বায়ু বইবে ততদিন অনন্তকালের মতো মুজিবনগর দিবস ইতিহাসের কালপঞ্জিকায় চির অমর হয়ে রইবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর