Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক্রিমিয়া সংকট: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা?


২৯ এপ্রিল ২০২১ ১৬:১২

ক্রিমিয়া নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সামরিক পদক্ষেপ নিলে তা  সাথে বিশ্বযুদ্ধে গড়াতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে এই মুহূর্তে রাশিয়ার সাথে বিশ্বযুদ্ধে জড়ানোর মতো সামর্থ্য নেই যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে ভবিষ্যতে ক্রিমিয়ার মতো রাশিয়ার দখলে চলে যেতে পারে পূর্ব ইউক্রেন। এমনকি রাশিয়ার আশেপাশে আরও কিছু দুর্বল দেশের একই পরিণতি হতে পারে। ক্রিমিয়া নিয়ে বর্তমান যে সংকট তা যে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বয়ে আনবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?

ক্রিমিয়া রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ কোন সামরিক পদক্ষেপেও যায়নি। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ার সাথে বিশ্বযুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে দেখতে হতে পারে ক্রিমিয়ার মতো আরও ঘটনা। এটি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই আর মেনে নিতে না চাইলে যেতে হবে সামরিক পদক্ষেপে, যা টেনে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বযুদ্ধের দিকে।

বর্তমানে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে ঈর্ষণীয় অবস্থানে আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদিও দেশে তার জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ। টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি রাশিয়া শাসন করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত আর বিধ্বস্ত রাশিয়াকে তিনি আবারও বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে টেনে তুলেছেন। রাশিয়াকে আবারও প্রভাবশালী অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছেন।

এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী রাশিয়াকে আবারও অনেকটা পুরনো অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়া আবারও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র চিন্তিত রাশিয়ার উত্থানে, বিশেষ করে আধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে রাশিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা— ভবিষ্যতে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য রাশিয়া প্রথমে পারমাণবিক হামলা পরিচালনার নীতি অবলম্বন করতে পারে। ফলে রাশিয়াকে মোকাবিলার নতুন করে প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশই অপ্রকাশ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রস্তুতি বেশি চলছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং তা দৃশ্যমান। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে রাশিয়াকে মোকাবিলায় সীমিত শক্তির নতুন পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং তা সাবমেরিনে মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ৯০ দশকের দুর্বল রাশিয়া যে আবার গৌরবময় অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে এর মূলে রয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্ব এবং ভিশন। বিশ্ব দরবারে পুতিনের অনেক কদর রয়েছে বটে কিন্তু দেশে বিরোধীদের দমন আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র সমালোচনাও রয়েছে তার। পুরনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নাভালনি দেশে ফিরেছেন এবং তিনি পুতিনকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চান।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের সাথে চলছে পুতিনের তিক্ত সম্পর্ক। এর আগে ডেমোক্র্যাটরা দায়িত্বে থাকাকালে হিলারি ক্লিনটন পুতিনকে উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে সে কারণে পুতিন চেষ্টা করেছেন হিলারি ক্লিনটন যেন প্রেসিডেন্ট না হতে পারেন।

বর্তমানে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আছেন। পুতিন মনে করছেন জো বাইডেন ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করতে যার শেষ পরিণতি হবে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। পুতিনের বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতি ক্ষোভ এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের আগুনে ইন্ধন যোগানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের এই চেষ্টা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

পুতিন মনে করেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমাদের তীব্র ঘৃণা প্রচারের শিকার হয়েছেন। যেমন এবিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন পুতিনকে একজন খুনি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকের মতে ভূ-রাজনৈতিক এ সংকট রূপান্তরিত হতে পারে একটি বিশ্বযুদ্ধে।

গত মার্চে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ইউক্রেন সরকার ক্রিমিয়া দখলমুক্ত এবং পুনরায় একত্রীকরণ কৌশলকে অনুমোদন দিয়েছে। এটি এমন একটি ঐতিহাসিক দলিল যা ২০১৪ সাল থেকে প্রয়োজন ছিল। ক্রেমলিনের অবস্থান হলো ক্রিমিয়াকে দখলে ইউক্রেনের যে কোনো প্রচেষ্টার মানে হবে সরাসরি যুদ্ধ। পশ্চিমা দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ক্রিমিয়া পুনর্দখল করতে যাওয়া মানেই ইউক্রেন রাশিয়ান সেনাবাহিনী দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া। ক্রিমিয়া উদ্ধার নিয়ে ইউক্রেন সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা ছাড়া রাশিয়ার সেনাবাহিনী কোনো পদক্ষেপে অগ্রসর হবে না। ইউক্রেন অবশ্যই চায় ক্রিমিয়াকে ফিরে পেতে।

পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ার সাথে কোন যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় এবং রাশিয়ার হুমকির পরিণতি নিয়ে ন্যাটোর সদস্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে রয়েছে মতভেদ। ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর দৃঢ় ঐক্য ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে সেনা মোতায়েন তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বাইডেনের হোয়াইট হাউজে প্রবেশ রাশিয়ার জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া দ্বন্দ্ব কিছুটা কমে এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এ সময় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থায় পৌঁছায়। ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার পরিবর্তে চীনকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করায়, এছাড়া তার মনোযোগ ছিল ইরানের প্রতি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের জায়গা থেকে সরে আসার পরেও শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়াকে মোকাবিলায় সাবমেরিনে নতুন পারমাণবিক বোমা মোতায়েনের নির্দেশ দেয়, বিশেষ করে রাশিয়ার মিসাইল প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বিচলিত হয়ে পড়ে পেন্টাগন।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে এ সময় প্রকাশ্যে রাশিয়াকে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং রাশিয়া ইউরোপের ন্যাটো সদস্যদের উপর আগে হামলা করে যুদ্ধে জয়ী হওয়া নীতি অবলম্বন করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের বিশ্বাস রাশিয়া সীমিত পরিসরে ইউরোপে পারমাণবিক হামলা পরিচালনা করতে পারে।

রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করে, ঠিক একই পদ্ধতিতে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল নিয়েছে। প্রতিবাদ ছাড়া এসব দুর্বল দেশগুলোরও রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি কখনও সামরিক কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। পশ্চিমাদের পরাজিত করতে পুতিনের সমস্ত ইউক্রেন দখলের দরকার হয়নি। তার দরকার ছিল ইউক্রেনের ছোট একটি অংশ দখল করা, যেমনটি করেছিল ২০০৮ সালে জর্জিয়ার ক্ষেত্রে। এটি করতে পুতিন প্রথম প্রয়োগ করেছেন তার বিশেষ স্ট্র্যাটেজি। পুতিনের বিশেষ কৌশল হলো কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদ তৈরি করা, ভাগ করা আর দখল করা নীতি। পুতিন রাশিয়ার আশেপাশের দেশগুলোতে ভবিষ্যতেও এ নীতি অব্যাহত রাখবেন। এটি ঠেকাতে বাইডেন প্রশাসন পূর্বের প্রশাসনের চেয়ে বেশি কিছু করবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

২০০৮ সালে জর্জিয়া এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি। আসলে আমেরিকান কোনো নেতাই চান না ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়াতে, যা শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে। আর বাস্তব হলো যুক্তরাষ্ট্রের এখন সে সামর্থ্য নেই। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সামর্থ্য রাখে না। এমন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হবে তা নিশ্চিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে যত ভার্চুয়াল ওয়ার গেম পরিচালনা করেছে তাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের শোচনীয় অবস্থার চিত্রই ফুটে উঠেছে।

মস্কো বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে। রাশিয়ান বাহিনী ক্রমেই শক্ত অবস্থান তৈরি করছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়। আর সর্বশেষ তারা মহাকাশে বেপরোয়া আচরণ এর পরিচয় দিচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গত বছর সবচেয়ে বড় সাইবার গোয়েন্দা হামলার অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা প্রতিরোধ করতে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছুই করতে পারেনি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তা হলো মিত্রদের দায়িত্বহীন আচরণে উৎসাহিত করা।

বাইডেন এখন যা করতে পারেন তা হলো, রাশিয়ার সাথে সরাসরি আলোচনায় বসা। তা না হলে পুতিন পূর্ব ইউক্রেনও পরিপূর্ণ দখল নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ইউক্রেন বাস্তবে আর কোনো দেশ থাকবে না। এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের এটা মেনে নিতে হবে অথবা ইউরোপে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ সূচনার মহা ভুল পদক্ষেপের সূচনা হতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এখন সমস্ত মনোযোগ ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

এখনো সালমানকে মিস করেন মৌসুমী
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৩

সালমান শাহ্‌কে হারানোর ২৮ বছর
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৪

সম্পর্কিত খবর