ভারতে করোনা সুনামি; কোথায় থামবে এ মৃত্যুর মিছিল?
৪ মে ২০২১ ১৫:৪৪
ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে সুনামি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারতে কেন এমন পরিস্থিতি হলো আর এর প্রভাব কী— তা সকলের কল্পনার বাইরে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অনেক ডাক্তার হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এবার টানেলের শেষ প্রান্তে কোনো আলো দেখার আশা নেই। পেটের অভাবে করোনায় মরণাপন্ন অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে পথেই মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ চার থেকে পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে মারা যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন সাপোর্ট, জীবন রক্ষাকারী জরুরি ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট রয়েছে ডাক্তার এবং নার্সের।
গত বছরের ১১ জুন ভারতে দৈনিক করোনা পজিটিভ শনাক্তের সংখ্যা ১১ হাজারের নেমে এসেছিল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গোটা ভারতে জীবনযাত্রায় কোথাও করোনার তেমন কোনো ছাপ ছিল না। সবকিছু ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। জনাকীর্ণ কুম্ভ মেলা, গঙ্গাস্নান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের জনাকীর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের সাথে চলছিল বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণা। নতুন করে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসবকে দায়ী করছেন।
অনেকে দায়ী করছেন বিজেপি সরকারের নীতিকে। তারা অভিযোগ করছেন সরকার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানোর জন্য সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারকরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে তা আরও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। সরকারের বার্তায় বিভ্রান্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। জনগণ সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকে। সরকার ভোটের আয়োজন করেছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছে। করোনা আক্রান্ত যখন দৈনিক প্রায় দুই লাখ সে সময় ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছে ভক্তরা।
এই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ক্রমে মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে এবং দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ফাতাহ উদ্দিন বিবিসিকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে আমি সতর্ক করে বলেছিলাম করোনা যায়নি। এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে করোনা সুনামি আকার ধারণ করবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো আমরা করোনা সুনামির কবলে পড়েছি। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে–এ মিথ্যা ধারণার কারণে কেউই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থামানোর পদক্ষেপ নেয়নি।
বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমগ্র ভারতজুড়ে বর্তমানে তীব্র সংকট চলছে হাসপাতাল বেডের। চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন রোগীরা। রাজধানী দিল্লি, মুম্বাই এবং আহমেদাবাদের হাসপাতালগুলোতে তীব্র বেড সংকট। সবচেয়ে বেশি সংকট অক্সিজেন সাপোর্টসহ জীবন রক্ষাকারী জরুরি ওষুধের। ভূপাল, কলকাতা এবং এলাহাবাদসহ অনেক শহরের পরিস্থিতিও একই রকম।
উত্তরপ্রদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির হাতে লেখা একটি নোট ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী করোনা পজিটিভ। গতকাল হেল্পলাইনে কমপক্ষে ৫০ বার ফোন করেছি কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দেয়নি। আজ সকালে মারা গেছে আমার স্ত্রী’। পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ অনন্ত ভান বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা করোনার প্রথম ঢেউ থেকে কোনো শিক্ষা নেইনি। বিভিন্ন রাজ্যের শ্মশানগুলোতে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা চলছে মৃতদেহ সৎকারের কাজ। অনেক শ্মশানে এতই ভিড় যে আত্মীয়-স্বজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে মৃতদেহ সৎকারের জন্য। শ্মশানের পরিস্থিতি দেখে অনেকের বিশ্বাস— প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি’।
উত্তর প্রদেশের রাজধানীর একজন ফটো সাংবাদিক ১৪ এপ্রিল বিবিসিকে বলেন, তিনি শহরের একটি শ্মশানে গিয়ে ১০০টি মৃতদেহ গুনেছেন যেগুলো দাহ করার জন্য সেখানে নেওয়া হয়েছে। ওইদিন সহকারি হিসেবে ওই রাজ্যে মাত্র ৮৫ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন আকাশ ধোঁয়ায় কমলা রং ধারণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা করোনা বিষয় মৃত্যুর সঠিক খবরা-খবর সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছি না।
অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে মারা যাচ্ছে কোনো পরীক্ষা এবং চিকিৎসা ছাড়াই। অনেকে হাসপাতালে মারা যাচ্ছে, কিন্তু তাদের ডেড সার্টিফিকেটে করোনা লেখা নেই। অনেক ছোট শহরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, এমনকি বর্তমানে যেসব শহরে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে সেখানে অনেকের পক্ষে করোনা টেস্ট করানো সম্ভব হচ্ছে না।
গত বছরের গোড়ার দিক থেকেই ভারত করোনা জয়ের আনন্দে ভাসতে থাকে। রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক এবং মিডিয়ার একাংশ বিশ্বাস করে ভারত থেকে করোনা বিদায় নিয়েছে। কেউ কেউ নরেন্দ্র মোদিকে আখ্যায়িত করেছেন ভ্যাকসিন গুরু হিসেবে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে নির্বাচন কর্তৃপক্ষ পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করে। সাতাশে মার্চ থেকে একমাস পর্যন্ত চলে এ নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয় মহাধুমধামে এবং তাতে ছিল না করোনাকে পাত্তা দেওয়ার কোনো বিষয়।
মার্চ মাসে ক্রিকেট বোর্ড ভারত ইংল্যান্ড ম্যাচ দেখার জন্য গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক প্রবেশের অনুমতি দেয়, যেখানে অধিকাংশ ছিল মাস্ক ছাড়া। এভাবে কুম্ভ মেলা, গঙ্গাস্নান থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একপ্রকার বিদায় নেয় করোনার নিয়ম কানুন। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত করার জন্য ভারত সরকার বল গড়িয়ে দিয়েছে আক্রান্ত হওয়ার দিকে।
এক মাসেরও কম সময়ে ভারতে সুনামির আকার ধারণ করে দ্বিতীয় ঢেউ। দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। সামাজিক গণমাধ্যমে শুধু দেখা যায় শ্মশানের চিতা দাহের ভিডিও, অ্যাম্বুলেন্সে আর আত্মীয় স্বজনের বিলাপের দৃশ্য।
বেড, অক্সিজেন আর জীবন রক্ষাকারী ওষুধের জন্য চলছে হাহাকার। টেস্টের রেজাল্ট পেতে লাগছে কয়েক দিন। এর মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একের পর এক রোগী মারা যাওয়ার খবর আসছে। এ নিয়ে আদালতের নির্দেশনা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি দেশের কাছে অক্সিজেন পেতে সাহায্য চায় কেন্দ্রীয় সরকার। অক্সিজেন না পাওয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ।
ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকার জন্য অর্থ পরিশোধ করে বাংলাদেশে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০ লাখ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও এরপর বাংলাদেশে আর কোনো টিকা আসেনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে আর্থিক সংকটের কারণে তারা চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল তাও এক রহস্য। এভাবে মোদির ভ্যাকসিন কূটনীতি শুধু দেশটির জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ হলো উত্তর প্রদেশ। করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ যে সব রাজ্যে তার মধ্যে অন্যতম এটি। করোনার প্রথম তরঙ্গ এ রাজ্য বেশ ভালোভাবে সামাল দিলেও দ্বিতীয় তরঙ্গে সবকিছুর লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড আছে। অনেক রোগী এখন বলছেন কোথায় সেসব বেড? বিমল কাপুরের ৭০ বছর বয়সী মা নির্মলা কাপুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার মায়ের দেহ শ্মশানে নেওয়ার সময় বিমল কাপুর বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং আমি দেখেছি অনেকে মারা যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে।
২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে ২০২১ সালের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পার্থক্য হলো, ২০২০ সালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু এবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খোলা রাখার পরিণতিতে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে অর্থনীতি।
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে ভারতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ট্রাভেল, ট্যুরিজম, শপিংমল এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা। অ্যাভিয়েশন, ট্যুরিজম, জ্বালানি, অ্যালকোহল এবং সিগারেট ভারতের বড় কয়েকটি রাজস্ব আয়ের খাত। এর প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দ্বিতীয় ঢেউয়ে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতের জন্য উদ্বেগজনক ও নেতিবাচক ঝুঁকি বহন করছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশটির দরিদ্র শ্রেণী। করোনাভাইরাসকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখা কি ভারতের বর্তমান এ অবস্থার জন্য দায়ী? এখন দেখার বিষয় কিভাবে ভারত করোনার এ সুনামি মোকাবিলা করে স্বাভাবিক অবস্থায় পুনরায় ফিরতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়