চীন-ভারত সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাজনীতি
৫ মে ২০২১ ১৭:২০
বিশ্বের অন্য কোনো দেশের চেয়ে চীনের সাথে ভারতের অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। দুই দেশেরই ১০০ কোটির বেশি জনসংখ্যা। দুই দেশের আছে বৃহৎ অর্থনীতি। ২০০৮ সালে চীন ছিল ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও দেশ দুটির মধ্যে এমন কিছু বিরোধের বিষয় আছে যেগুলো সমাধান না হলে বৃহৎ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব হবে না, আর এর প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর।
বর্তমানে চীন ও ভারতের মধ্যে গত ত্রিশ চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক বিরাজ করছে। হিমালয় অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ লাদাখ সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের পর তা আরও খারাপ হয়েছে। গত বছর ঐ সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। চীনের কত সৈন্য মারা গেছে তা অবশ্য প্রকাশ করেনি দেশটি। দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজেদের ভূখণ্ডে সেনাদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেছে।
লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালে একবার লাদাখ সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের পর থেকে চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা একটা কঠিন পর্যায় পার করছি যদিও আমাদের সম্পর্ক ইতিবাচক দিকেই এগিয়ে চলেছে। দুই দেশের সীমান্তে বড় ধরনের সেনা সমাবেশ না করার একাধিক চুক্তিতে পৌঁছেছে তারা। ভারতের অভিযোগ— চীন সম্প্রতি চুক্তি লঙ্ঘন করে লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে হাজার হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে। চীনের এই পদক্ষেপে দুই দেশের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ভারতও যে লাদাখ সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করছে তা অবশ্য জয়শঙ্কর এড়িয়ে যান।
সীমান্ত সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হলেও তাতেও অচলাবস্থা কাটেনি। এই সমস্যার সমাধান না হলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। বেইজিংভিত্তিক সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের সিনিয়র ফেলো এন্ডি মং মনে করেন, চীন-ভারত সম্পর্ক একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে আর এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ভারতের চীন বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা। ভারতের এই চেষ্টা শুধু দেশটির সাথেই নয় বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও একটা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে নয় বরং চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার মাধ্যমেও ভারত আরও বেশি লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক স্থবির হয়ে আছে। সার্ককে পাশ কাটিয়ে ভারত অন্যান্য উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগে জড়িত হচ্ছে। যেমন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক সংস্থা বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকটিকাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন বা বিমসটেক নেতাদের আমন্ত্রণ জানান। এই সংস্থার পাঁচটি সদস্য দেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ,ভারত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড।
ভারতের অতীত ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দিল্লির উপ আঞ্চলিক জোট গঠনের চেষ্টা তেমনভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। নেতৃত্ব সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব এক্ষেত্রে বড় কারণ। ঢাকায় বিমসটেকের একটি স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে ১৭ বছর লেগেছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর বিসিআইএম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
সার্কের পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়াতে ভারত আরও উপ আঞ্চলিক জোট গঠনের দিকেই হাঁটবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ গঠনের কারণে ভারতের উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারত বিমসটেক গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার অনেক আগ থেকেই চীনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও কানেক্টিভটির পরিকল্পনার ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। বিমসটেকের চীনের অনুপস্থিতির কারণে ভারত এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দেওয়ার সফলতা নিয়ে অনেক বিশ্লেষক আগে থেকেই সন্দিহান ছিলেন।
এ সম্পর্কে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্রীনিবাসন বলেন, বিমসটেকের দেশগুলোর অর্থনীতির অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানের পাশাপাশি এসব দেশের অর্থনীতির নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। একই সঙ্গে এতে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অনুপস্থিতি ভারতের উদ্যোগের গতিকে শ্লথ করে দেবে। কেননা চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশের পক্ষে বড় বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত বহু দেশীয় উদ্যোগের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আঞ্চলিক যে কোনো নিরাপত্তা উদ্যোগকে তার নিজস্ব স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে ব্যবহারের চেষ্টা করে, এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বড় ভাই সুলভ আচরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একতরফাভাবে ভারত কোনো উদ্যোগ নিলে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলো সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক শক্তির দেশ চীন ভারতকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এ অংশগ্রহণে ভারত অনীহা দেখালেও এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো ভারতকে অনুসরণ করেনি বরং তারা চীনের উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে এর ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুতই চীনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তার বড় প্রমাণ
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য সুব্রামানিয়াম স্বামী বলেছেন পাক ভারত সীমান্ত দিয়ে না নিয়ে বরং কলকাতা-মুম্বাই দিয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি চীনের বিবেচনা করা উচিত। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পরস্পরের প্রভাব খর্ব করতে চীন ও ভারত এই অঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিক কৌশল গ্রহণ করেছে।
২০০৭ সালে চীন সার্কের পর্যবেক্ষক দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর দেশটি সার্কের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। কিন্তু ভারতের অনাগ্রহের কারণে বিষয়টি আর অগ্রসর হতে পারেনি। অথচ সার্কে যুক্ত হলে চীনের বড় বিনিয়োগে সার্কের গতি আরও জোরদার হতে পারত। পর্যবেক্ষকের মর্যাদার কারণে চীন সার্কের কোনো ফোরামেই কোনো প্রস্তাব উত্থাপন বা আলোচনা করতে পারছে না। চীনকে পূর্ণ সদস্য বানালে ভারত আগের মতো সার্ক তার প্রভাব খাটাতে পারবে না জেনেই দেশটি চীনকে সদস্য পদ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। অথচ চীনকে সার্কের সদস্য করা হলে এই অঞ্চলের ছোট দেশগুলোর অর্থনীতি বেশি লাভবান হতো বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে বড় ভূমিকা পালন করতে দিতে ভারতের অনাগ্রহের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভারত মনে করে, চীন এই অঞ্চলে বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ পেলে এশিয়ার অর্থনীতি চীনকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। ভারতের এই আশঙ্কার বড় কারণ হচ্ছে চীনের অনুকূলে ভারতের বড় বাণিজ্য ঘাটতি।
চীন ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে চীনের কূটনীতি বুঝতে ভারতের ব্যর্থতা। এ কারণে আঞ্চলিক দৃশ্যপটে ভারত-চীনকে একটি আনপ্রেডিক্টেবল খেলোয়াড় হিসেবে মনে করে। যেমন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে চীনের উহানে নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যে বৈঠক হয়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে চীন কাশ্মীর ইস্যু আবারও তোলার চেষ্টা করে। এ ঘটনা ভারতের কৌশল নির্ধারণী মহলকে বড় একটা ধাক্কা দেয়।
দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাতের আশঙ্কা কমানোর লক্ষ্যে উভয় দেশই পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও দুদেশই স্নায়ুযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশই পরস্পরের আঞ্চলিক প্রভাব কমাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা কৌশল গ্রহণ করছে।
এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথ রুদ্ধ করতে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ,জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি অঘোষিত জোট গঠন করেছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ভারতের প্রতিবেশী নেপালের সাথে রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তিব্বত থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত এ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে চীন-ভারতের ঘাড়ের কাছে নিজের অবস্থান জোরদার করবে। একই সঙ্গে চীন ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত অবস্থান জোরদার করতে পাকিস্তানকেও নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানে তালেবান ও দেশটির সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতার করছে বেইজিং। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এই অঞ্চলের বৃহত্তর পরিসরে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে পেছনে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় একটি পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু গত চার দশকে সংস্কার ও বিশ্বের জন্য চীনকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে দেশটি আজ এক বৃহৎ পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে চীনের বিপুল অর্থ-সম্পদ, শিল্প শক্তি ও সামরিক সক্ষমতা এক অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছে। অন্যদিকে ভারত অন্য পরাশক্তিগুলোর সহযোগিতা নিয়ে চীনকে মোকাবেলার চেষ্টা করছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়