অনুসন্ধানের ক্ষয়, প্রেস রিলিজের জয়!
১৯ মে ২০২১ ০০:৩২
বর্তমান যুগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বড় সংকট ইন ডেপথ রিপোর্টিংয়ের অভাব, অর্থাৎ সংবাদের গভীরে আর কেউ যান না বা যেতে পারেন না। গণমাধ্যমে যা আমরা পাই তা স্রেফ ভাসা ভাসা তথ্য। কর্তৃপক্ষ যতটুকু জানাতে চায় ততটুকুই জনগণের কাছে আসে সাংবাদিকদের হাত ঘুরে। এমন কথা অহরহই শোনা যায়— সমালোচনা করে, আক্ষেপ করে বলেন অনেকে। মৌলিক কোনো বিষয়, অধিক গবেষণা করা, গোপন কোনো তথ্যের উন্মোচন করে সংবাদ পরিবেশন এখন কদাচিৎ দেখা যায়। যারা করেন, তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তাদের হেনস্থা হতে হয় রোজিনা ইসলামের মতো!
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দিন দিন পেছাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছর, ২০২১ সালেও আরও এক ধাপ পিছিয়েছে অবস্থান। ২০২০ সালে ১৫১ থেকে এক বছরের ব্যবধানে এক ধাপ নেমে গেছে লাল সবুজের বাংলা। ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৫২তম। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো রয়েছে আমাদের আগে। তালিকায় মালদ্বীপের অবস্থান ৭৯তম, নেপাল ১১২, আফগানিস্তান ১২২, শ্রীলঙ্কা ১২৭, মিয়ানমারের অবস্থান ১৩৯, ভারত ১৪২ এবং পাকিস্তান ১৪৫। আমরা বলি উন্নয়নের সব সূচকেই পাকিস্তান থেকে ঢের এগিয়ে বাংলাদেশ কিন্তু এই ক্ষেত্রে এতো পেছনে, সেটি কি কোনো লজ্জার বিষয় নয়! বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-আরএসএফ এই সূচক তৈরি করে। তারা নানা সময়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন নিয়ে। মুক্তমত, স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ নিয়ে সতর্কও করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো পরিস্থিতি দিন দিন খারাপই হচ্ছে। অনুসন্ধানের ক্ষয়ে প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতার জয় দিন দিন আসন পোক্ত করছে। এতে হারাচ্ছে মেধা ভিত্তিক কাজ, সাংবাদিকতার মাহাত্ম্য হচ্ছে ম্লান।
দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা যেটা হয়েছে তা তার আগের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের খেসারৎ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির আদ্যোপান্ত তুলে ধরাতেই তিনি ক্ষোভের শিকার হয়েছেন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাত কতটা দুর্নীতির আখড়া তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদা চোখেই যা বলা যায়। প্রমাণসহ এই খাতের দুর্নীতি তুলে ধরে চক্ষুশূল হয়েছেন রোজিনা। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটি তাকে নির্দিষ্ট করেই করা হয়েছে অর্থাৎ যা ‘প্রি-টার্গেট’। তিনি রোজকার মতো গেছেন সংবাদের কাজে, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তথ্য নিতে। যা তার দায়িত্ব, যা সাংবাদিকতার নীতির মধ্যে পড়ে। সেসময় তাকে কায়দা করে ধরা হয়, আটকে রাখা হয় পাঁচ ঘণ্টার মতো সময়। এই সময়কালে যারা গায়ে হাত তুলেছেন, তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আক্রোশের অংশ হিসেবেই যা হয়েছে। একে আমলাতন্ত্রের নগ্ন আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কতটা বেপরোয়া হলে কয়েকজন সচিব, উপ-সচিব পর্যায়ের মানুষ এমনটা করেন, তাই ভেবে পাচ্ছি না কূল। তারা কেবলই সরকারি দাস, গণ-মানুষের চাকর। রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের দায়িত্ব দিয়েছে কল্যাণের, ব্যক্তিগত ঝুলি ভরতে নয়। যখনই তাদের গায়ে আঁচ লেগেছে সংবাদের কালিতে, তখনই তারা ক্ষেপে গিয়ে ঘটিয়ে ফেললেন এমন কাণ্ড। সাংবাদিক রোজিনা নয়, উল্টো আমলাতন্ত্রের দাম্ভিক বিষফোঁড়াদের কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাদের অপসরণ জরুরি। তাদের যারা মদদ দেয়, তাদের বহিষ্কারের সময় এসেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে এসব তথাকথিত শিক্ষিত, বিসিএস পাস মানুষরাই মূল বাধা। তারা দেশপ্রেমিক নয়, তারা শত্রু, জনগণের অরাতি।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি তার নেতাকর্মীদের নিয়ে ঈদ পরবর্তী আলাপ আলোচনা করছেন। কথায় কথায় তিনি ধুয়ে দিলেন আমলাতন্ত্রকে। সরকারের দুর্নাম কুড়ানোর জন্য অনেকাংশে আমলাতন্ত্র দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি। খুব ছোট পদের নেতা তিনি, ঢাকা উত্তরের এক ওয়ার্ডের। অথচ তিনিও বোঝেন, সমস্যাটা কোথায়। আফসোস, বড় বড় মন্ত্রীরা এ কথা বুঝেও কতটুকুই বা সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নিচ্ছেন! বড় নেতাদের মন-মনন জাগুক, বিবেক জাগুক— রাজনীতি জনগণের জন্য, জনগণের পক্ষে কথা বলুন, এখনও সময় আছে। কেউ ক্ষমতায় চিরস্থায়ী নয়, বিষফোঁড়াদের থেকে সুবিধা না নিয়ে জনগণের ভালোবাসা নিন, টিকে থাকবেন।
আর ফিরি রোজিনা ইসলামের বিষয়ে। তাকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত করার প্রতিযোগিতার শুরু সচিবালয় থেকে। যা রাষ্ট্রের শীর্ষ স্থান। তার নামে মামলা থেকে শুরু করে কারাগারের ভাত খাওয়ানো, এগুলো সাংবাদিকতার জন্য কলঙ্ক। যেই কালো দাগ লাগলো, তা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করছি প্রতিটি জেলায়। সচিবালয়ে যদি এটি ঘটতে পারে, তাহলে অন্য সরকারি কার্যালয়গুলোতেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তা কে বলতে পারে! তাই ভয় হচ্ছে, মান সম্মানের ভয়, সাংবাদিকতার সম্মানের ভয়। ক্ষমতা আর দুর্নীতির দাপটে কত নিচে নামিয়ে আনছি আমরা এই মহান পেশাকে, রাষ্ট্রের স্তম্ভকে! এখন দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষীকে নয়, দোষ খুঁজে বের করা ব্যক্তিকে রাত কাটাতে হয় চোদ্দ শিকে!
এ ঘটনার পর আন্তর্জাতিকভাবে আরও সুনাম ক্ষুণ্ণ হলো আমাদের। বিশ্ব নতুন করে জানলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকলেও তা কতটা নাজুক। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সাংবাদিকের করুণ চিত্রই বলে দিচ্ছে, আমরা এখনও কত পিছিয়ে ঢের। এই পিছিয়ে থাকা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো। যার জবাব হোক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ আসার পর থেকেই স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যেন গুপ্তধন পেয়ে গেলেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এতো মানুষের মৃত্যু দেখেও তাদের মনে কাঁপন ধরেনি।