Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা প্রতিরোধে লকডাউন নয়, ভ্যাকসিনই একমাত্র সমাধান

আব্দুল বারী
১০ জুলাই ২০২১ ০০:১৮

অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। লকডাউনকালে করোনার বিস্তার ঘটেছে প্রায় তিন গুণ। লকডাউন দেশের অর্থনীতি ও জনগণের বিপরীতে কাজ করছে। লকডাউনের আগের এক সপ্তাহে দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫২, ১০৮ জন। মারা গেছেন ৮০১ জন। লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছেন ২,২১, ৯১৩ জন। যা পূর্বের এক সপ্তাহের তুলনায় ১, ৬৯, ৮০৫ জন বেশি। মারা গেছেন ১,০৭২ জন। এই সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ২৭১ জন বেশি।

কোভিড-১৯ নতুন ধরনের একটি ভাইরাস। এটা সাধারণ ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞদের চিন্তার বাইরে। এ নিয়ে কত কথা যে শুনেছি তার হিসাব নেই। কেউ বলেছেন করোনা ডিম থেকে জন্মাচ্ছে, কেউ বলেছেন করোনা শীতে বাড়ে, করোনা গ্রীষ্মপ্রধান দেশে অকার্যকর ইত্যাদি ইত্যাদি। সময়ের ব্যবধানে প্রমাণিত হয়েছে যা শুনেছি তার সবই কল্পনার বেসাতি ছাড়া কিছুই নয়।

বিজ্ঞাপন

সেই হিসেবে বলা যায় লকডাউন আন্দাজপ্রসূত একটি কর্মসূচি। নবীনগরে হুজুরের জানাজায় মুসল্লি সমাগম দেখে “আন্দাজ” পণ্ডিতরা যা বলেছিলেন তার কিছুই ঘটেনি। এভাবে ঈদে বাড়ি যাওয়া, গার্মেন্টস খোলা রাখা নিয়েও রটনা কম হয়নি।

তারপরও বলি, করোনা প্রতিরোধে জেলা উপজেলায় লকডাউন গেমের প্র্যাকটিস অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এব্যাপারে বেশি উৎসাহী সেই কান ধরানো এসিল্যান্ড, ছাগলকে জরিমানা করা ইউএনও এবং পুকুরওয়ালা সেই ডিসির মতো অতিউৎসাহী ক্ষুদে আমলারা। লকডাউন তাদের জন্য পোয়াবারো— কারণ, কথিত লকডাউন কার্যকর করার জন্য আছে সরকারি বরাদ্দ। সেই বরাদ্দের টাকা হজম করতে হলে লকডাউন খুবই দরকারি।

এতে কাজের কাজ কী হয়েছে? সে পরিসংখ্যান তারা দেখেছে কিনা জানি না। তবে দেশব্যাপী জারী করা লকডাউন যে করোনা আক্রান্তের হার ও মৃত্যু কমাতে পারেনি, এটা নিশ্চিত।

বিজ্ঞাপন

এই দাবি প্রমাণ করতে হলে দেখতে হবে, এবারের লকডাউন শুরুর আগের ও পরের সাত দিনের পরিসংখ্যান।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেসবিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, ১ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩২,০৫৫ জন। মারা গেছেন ১৪৩ জন। ২ জুলাই আক্রান্ত ৩০,০১২ ও মৃত্যু ১৩২ জন। ৩ জুলাই আক্রান্ত ২২,৬৮৭, মৃত্যু ১৩৪ জন। ৪ জুলাই আক্রান্ত ২৯,৮৭৯ মৃত্যু ১৫৩ জন। ৫ জুলাই আক্রান্ত ৩৫,০০২, মৃত্যু ১৬৪ জন। ৬ জুলাই আক্রান্ত ৩৬,৬৩৯, মৃত্যু ১৬৩ জন। ৭ জুলাই আক্রান্ত ৩৫,৬৩৯, মৃত্যু ২০১ জন। অর্থাৎ সাত দিনে ২,২১,৯১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১০৭২ জন।

লকডাউন ঘোষণার এক সপ্তাহ আগে ২৩ জুন ৫,৭২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, ৮৫ জন মারা গেছেন। ২৪ জুন আক্রান্ত ৬,০৫৮ জন, মারা গেছেন ৮১ জন। ২৫ জুন আক্রান্ত ৫,৮৬৯ জন, মারা গেছেন ১০৮ জন। ২৬ জুন আক্রান্ত ৪,৩৩৪ জন, মারা গেছেন ৭৭ জন। ২৭ জুন আক্রান্ত ৫,২৬৮ জন, মারা গেছেন ১১৯ জন। ২৮ জুন আক্রান্ত ৮,৩৬৪ জন, মারা গেছেন ১০৪ জন। ২৯ জুন আক্রান্ত ৭,৬৬৬ জন, মারা গেছেন ১১২ জন। ৩০ জুন আক্রান্ত ৮,১২২ জন, ১১৫ জন। অর্থাৎ লকডাউনের আগের সাত দিনে ৫২,১০৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন ৮০১ জন।

লকডাউনের ৭ দিনে আক্রান্ত ২,২১,৯১৩ জন। যা পূর্বের আক্রান্ত সংখ্যা থেকে ১,৬৯,৮০৫ জন বেশি। আগে মারা গেছেন ৮০১ জন, পরে ১০৭২ জন। যা আগের তুলনায় ২৭১ জন বেশি।

এই সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের সময় আক্রান্ত যেমন বেশি, মৃত্যুও তেমনই বেশি। তাই এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, লকডাউন কর্মসূচি কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।

পক্ষান্তরে লকডাউন কার্যকর করতে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। লকডাউনের নামে ঝুঁকি ভাতা টিএডিএসহ নানা অজুহাতে হরিলুট হয়ে যাচ্ছে সরকারি টাকা। অপরদিকে লকডাউনের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতির উপর। ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষতি তো উদ্বেগজনকভাবে দৃশ্যমান।

এরপরও গবেষণা পার্টি বলছে, লকডাউন বাড়ালে করোনা শিকার না পেয়ে পালিয়ে যাবে। এই কথা যে কেবলই অনুমান নির্ভর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাদের এই মতও আন্দাজপ্রসূত। তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করার মতো অনেক দিক রয়েছে। যেমন, লকডাউনের মধ্যে চালু রয়েছে শিল্পাঞ্চল। সেখানে করোনার প্রভাব পড়েনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার জোয়ান একসঙ্গে কাজ করছে। তাদের মধ্যে করোনা থাবা বসায়নি।

রাজধানী ঢাকা অনেকটা খোলামেলাভাবেই চলছে। তারপরও দাবি করে বলা যায় ঢাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব নেই। এর কারণ হলো এই যে, ঢাকার বেশিরভাগ চল্লিশোর্ধ্ব লোক ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তাই এখানে করোনা থাকলেও মৃত্যু হার বাড়েনি।

করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের ভারত লাগোয়া জেলা সমূহে। এর অন্যতম কারণ হলো এসব অঞ্চলে ভ্যাক্সিনেশন তেমন হয়নি। তারা মনে করেছিলেন গ্রামাঞ্চলে করোনা হবে না। তাই বেশিরভাগ মানুষ ভ্যাকসিন নেয়নি। যার ফলে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু হার বেড়েছে।

কুষ্টিয়া শহরের সাংবাদিক সোহেল রানা জানালেন, তার পরিবারের কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনিও আছেন। টেস্টে তার করোনা পজিটিভ দেখালেও কোনো উপসর্গ নেই। তার মানে হলো এই যে, তিনি ভ্যাকসিন নেওয়ায় করোনা তাকে শয্যাশায়ী করতে পারেনি।

শুধু এখানেই নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন,দ্রুত দেশের ৭০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে। যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা নেই। দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি লোক টিকা নিয়েছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে বলেই সেখানে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ভ্যাকসিনেশন শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন দারুণভাবে কাজ করছে।

তাই লকডাউনের নামে অর্থনৈতিক ক্ষতি না করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি। সামাজিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ও মুখোশের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালু রাখা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।

আর এসব না করে আর বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ কমিটি লকডাউন দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টায় মত্ত।  এরপরও ইচ্ছা হলেই লকডাউন, ইচ্ছা হলেই ধরপাকড়, ইচ্ছে হলেই জেল জরিমানা করা ঠিক হবে না।

উপসংহারে বলতে চাই, আমি ডাক্তার নই। বিজ্ঞানীও নই, বিশেষজ্ঞ নই, কেবলমাত্র একজন সাদা চোখের সাংবাদিক। আরও একটু সোজা করে বললে, যা বুঝায় তা হলো এই যে, আমি বল খেলতে পারি না। তবে বলটি যে সঠিক ভাবে মারা হচ্ছে না সেটা বুঝি।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর