করোনার গোদের মাঝেই ডেঙ্গুর বিষফোঁড়া
১৮ জুলাই ২০২১ ২১:০৩
সারাবিশ্বেই এখন করোনা মহামারির প্রভাব চলছে। গত বছর থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত করোনা আতঙ্কে দিন পার করছে মানুষ। করোনার প্রভাবে বিশ্বের অর্থনীতিও যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। এর মধ্যে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বর্ষা মৌসুমের পুরোটা সময়জুড়েই ডেঙ্গু একটি আতঙ্কের নাম। এ বছরও ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করছে। একে করোনা মহামারির সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে, তার ওপর আবার ডেঙ্গু।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭২। আর জুলাই মাসের ১৫ দিনেই ৬৮৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যা ছয় মাসের আক্রান্তের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। বারবার নগরবাসীকে সচেতন করেও ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তারের মতো স্থান পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চাইলেই যা সহজেই প্রতিরোধ করতে পারি অর্থাৎ এডিস মশার বংশ বিস্তারের জায়গাগুলো ধ্বংস করতে পারি, সেই কাজ একটু অবহেলার জন্য করছি না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়।
মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম মারাত্মক হলো ডেঙ্গু। মশা খুব ছোট প্রাণী হলেও এটি অনেক বড় প্রাণীর চেয়ে মারাত্মক। এমনকি পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে এই কীট অত্যন্ত ভয়ংকর। এটি বহন করে মারাত্মক সব ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া। সামান্য কামড়েই শরীরে ছড়িয়ে পরতে পারে রোগ। এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটতে পারে মৃত্যুও। এদের মধ্যে ভয়ংকর হলো এডিস মশাা। স্ত্রী এডিস মশার কামড়েই ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। এছাড়া চিকনগুনিয়াও ভীতিকর। ডেঙ্গু তাই আমাদের কাছে এক ভয়ের নাম।
সম্প্রতি মশাবাহিত রোগ নিয়ে আরও ভয়ংকর একটি তথ্য পাওয়া গেছে। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের (এলএসএইচটিএম) করা গবেষণাটি সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, যেভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত হচ্ছে, তাতে আগামী ৫০ বছরে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়বে। ফলে আগামীতে মানুষকে বছরের একটি বড় সময়ই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়তে হবে। ২০৮০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০০ কোটির বেশি মানুষ ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তারপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এই চ্যালেঞ্জের কারণ পরিবেশ ও নিজেদের দায়বদ্ধতার অভাব। জনসংখ্যার ঘনত্ব ও পরিবেশের কারণে ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বেশ বেগ পেতে হবে।
গত বছরের পর থেকে বিভিন্ন মাধ্যমেই ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম চোখে পড়েছে। তারপরও শুরু থেকে এ বছর ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন ছাড়াও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে মানুষের সমাগম হয় সেরকম স্থানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। এডিস মশার প্রজননের ক্ষেত্রে ঢাকার পরিবেশ যেহেতু বেশি, তাই এখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। করোনার পর যেন এডিস মশার কারণে জনগণ ভোগান্তিতে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমাদের যে দায়িত্বগুলো রয়েছে তা পালন করতে হবে।
বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে যেখানে ময়লা-আবর্জনা বা সহজেই বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে, কর্তৃপক্ষের ভরসায় না থেকে সেসব স্থান নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে পারি। যেহেতু এডিস মশার বংশ বিস্তার ও এর ক্ষতিকর দিক আজ আমরা সবাই জানি, নিজেদের দায়িত্ব তাই আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। ফলে কোনো জানা বিষয়ে প্রতিরোধ করা সহজ হয়। প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা। আমাদের নিজেদের ও কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা মিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
এই বর্ষা মৌসুমে ঘরের ভেতর ও ঘরের বাইরে এডিস মশা জন্মানোর মতো কোনো জায়গা যেন না থাকে, ডাবের খোসা, টবের জমে থাকা পানি, খালের জমা পানি, ফ্রিজের জমা পানি, অর্থাৎ এডিস মশা জন্ম নেয়, এরকম সব স্থান ধ্বংস করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/টিআর