শিশু-কিশোরদের উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব
২৯ আগস্ট ২০২১ ১৭:৩১
গতবছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী মানুষজন নতুন একটি শব্দ শুনেছে। আর তা হল করোনা ভাইরাস। এটি এমন এক ভাইরাস যা স্তব্ধ করে দিয়েছে পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্য। শিশুরা করোনাভাইরাসে অপেক্ষাকৃত অনেক কম আক্রান্ত হলেও বলা হচ্ছে শিশুরা করোনাভাইরাসের নীরব শিকার।
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পরই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিশু, কিশোর ও তরুণরা গৃহবন্দি। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই কাটছে তাদের দিন-রাত। বন্দি ঘরে কীভাবে কাটছে তাদের সময়?
বেশিরভাগই অভিভাবক বলেছেন, পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই আগের মতো। পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে আর স্মার্ট ডিভাইসে। দিন-রাতের রুটিন বদলে গেছে। অনেকের আচরণে এসেছে পরিবর্তন। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকেরা।
শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বন্ধ বিনোদন কেন্দ্রগুলোও। ফলে ঘরের বাইরে শিশুদের বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। গত ডিসেম্বর কয়েকদিনের জন্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুললেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি করোনা সংক্রমন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজধানীতে শিশুদের সবচেয়ে বড় বিনোদনকেন্দ্র আগারগাঁওয়ে বিমান বাহিনীর জাদুঘর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘক্ষণ ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ব্যবহার করলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। শিশুরা মোবাইল হ্যান্ডসেট অনেকক্ষণ ব্যবহার করলে তাদের স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। শরীরে টিউমার হতে পারে। রেডিয়েশনের প্রভাবে একটা শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে।
জাতীয় নাক কান ও গলা ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. মাহবুব আলম বলেছেন, ‘দীর্ঘক্ষণ হেডফোন দিয়ে কথা বললে কানে নানা ধরনের সমস্যা হয়। তাই দীর্ঘসময় হেডফোন ব্যবহার না করাই উচিত। একটানা না শুনে বিরতি দিয়ে দিয়ে শুনতে হবে। দীর্ঘসময় মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় তাকিয়ে থাকলে চোখেরও সমস্যা হয়। অবশ্যই এ ক্ষতিগুলো খুব সহজে বোঝা যায় না, লম্বা সময় পর ধীরে ধীরে বোঝা যায়। বিশেষ করে শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস দেওয়ার সময় অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি বড়রাও মোবাইল ব্যবহারের সময় শিশুদের দূরে রাখতে হবে। কারণ মোবাইলের রেডিয়েশনটা শিশুদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. এনাম আবেদিন বলেন, ‘করোনার কারণে এখন তো অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে খুব একটা বের হচ্ছেন না। খুব দরকার না হলে হাসপাতালে আসেন না। ফলে চোখের যে ক্ষতিগুলো সেটা এখন আমরা ওভাবে বুঝতে পারছি না। এটা তো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, আরো বছরখানে গেলে শিশুদের যখন চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে তখন আমরা বুঝতে পারব করোনাকালীন সময়ে মোবাইল-ল্যাপটপের সামনে দীর্ঘক্ষন বসে থেকে বাচ্চাদের কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে।’
তবে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ মনে করেন শারীরিক ক্ষতির চেয়েও শিশুদের মানসিক ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই এক বছরে শিশুদের মারাত্মক কিছু ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মানসিক ক্ষতিটা অনেক বেশি। পাশাপাশি অনেক শিশু মোটা হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের সঙ্গে দূর্ব্যহারও বেড়েছে। তবে এসব নিয়ে এখনো বাংলাদেশে কোন গবেষণা হয়নি।’
এইসব বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার কথা বলছেন বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেনও। তিনি বলেন, ‘এখনকার তরুণরা বেশ সেনসেটিভ। তাদের খুব একটা বিরক্ত না করাই ভালো। আবার তাদের লেখাপড়ার মধ্যেও রাখতে হবে। টিভি দেখা বা ঘরের মধ্যে অন্য ধরনের খেলাধুলার (লুডু, দাবা, ক্যারাম) ব্যবস্থা করতে হবে। বাবা-মা সন্তান মিলে খেলতে হবে। এখন আপনি যদি নিজেই সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে তো আপনার সন্তানও তাই করবে! সন্তানকে সময় দেওয়ার এটা কিন্তু একটা ভালো সুযোগ। পাশাপাশি যে ধর্মের মানুষ আপনি, সেখানে সন্তানকে নিয়ে ধর্ম পালন করতে পারেন। মোট কথা স্কুল বন্ধ থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠাসহ তাদের একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আনতে হবে।’
২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারী শুরুর পর ইউনিসেফ শিশুদের নিয়ে একটা গবেষণা প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের তিনজনে একজন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু এখন আর অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। করোনার কারণে শিশু অপুষ্টির হারও বাড়ছে। পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের উপর নির্যাতন সহিংসতায় দুর্ব্যবহার ও বেড়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই