Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় বাড়ছে শিক্ষিত বেকার

আনন্যামা নাসুহা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:১৩

স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থীর পুরো শিক্ষাজীবন শেষ করতে ১৬ থেকে ১৮ বছর অতিবাহিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেশনজট মিলিয়ে আরও তিন চার বছর বেশি লেগে যায়। এরপর পরিবারের হাল ধরতে খুঁজতে হয় চাকরি। সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। কেউ চাকরি না পেলেই তার যোগ্যতা নেই বলে ধরে নেয় সমাজ। চাকরির বাজারের ব্যাপক প্রতিযোগিতায় অভিজ্ঞতা শব্দটি বরাবরই দীর্ঘশ্বাসের কারন। সদ্য স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীরা যেখানে চাকরি পাচ্ছিলেন না অভিজ্ঞতার অভাবে; এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল করোনা মহামারী। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কত সে বিষয়ে কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে এর সংখ্যা যে একেবারে কম নয় সেটি দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগের সময়। হোক তা সরকারি কিংবা বেসরকারি।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে বেকারত্বের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এই ভাবে- ১৫ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ করে না বা পায় নি।

করোনার আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ, এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণ। করোনা শুরুর তিন-চার মাসে ব্যাপকভাবে বেকারত্ব বেড়েছিল। গত মার্চ মাসে বেকারত্বের হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, জুলাইয়ে তা বেড়ে হয় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

গত তিন বছরে দেশে শ্রমশক্তি নিয়ে নতুন জরিপ করা হয়নি। এর আগে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরপর দুই বছর ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ করা হয়েছিল। তারপরেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছে ২০১৭ সালে। সেই জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। আর তাদের মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। শতাংশ হিসাবে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ২০২০ সালের মার্চের শেষ দিক থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে গেলে বহু মানুষ কাজ হারান। অর্থনীতি আবার সচল হলেও অনেকেই কাজ ফিরে পাননি। তারপরেও সরকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখই থাকবে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ওই বছরের হিসেবে দেশে ৬ কোটি ৮ লাখ লোক কাজের মধ্যে ছিলেন। ২০১৩ সালে যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে সাত লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু গত ২০২০ সাল থেকে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করেন। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরো বেড়েছে।

লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ)। সংস্থাটির তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভূক্ত।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। করোনার জন্য এই সংখ্যায় পৌঁছাতে হয়ত কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে না। দ্রুতই এই সংখ্যা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনাকালীন সময়ে নতুন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন কাজ হারানো আরো মানুষ। বেসরকারি সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বা এনজিওতে তৈরি হচ্ছে না কোন নতুন কর্মসংস্থান। ফলে বেড়েই চলছে বেকারত্ব।

বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় এসেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। আইএলও বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, বাংলাদেশে করোনায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছেন।

এর মধ্যে আশার সংবাদ হল একসঙ্গে দুই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), ৪২ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন হিসেবে ২০০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে ১ হাজার ৮১৪ জনকে। ৪২তম বিশেষ বিসিএসে চিকিৎসক ও ৪৩তম বিসিএসে সাধারণ ও প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হবে।

অনেকে কাজ শুরু করেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে, নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন ওমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, করোনায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ নারী অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে এসেছেন।

করোনাকালীন সংকটে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে আগ্রহী হয়েছেন। বিশেষভাবে শিক্ষিত নারীরা এই পথে বেশি এসেছেন। তবুও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইন্টারেনেটের সুব্যবস্থা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে কাজ। বেকারত্ব ট্যাগ ঘোচাতে এ যেন আরেক যুদ্ধ।

বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চিন্তা হওয়া উচিৎ কর্মসংস্থান। তবে প্রচলিত প্রণোদনার মতো টোটকা ওষুধে কর্মসংস্থানকে বেগবান করা যাবে না। বরং এর বাইরে গিয়ে একটি স্থায়ী নীতিকাঠামোতে আমাদের আসতে হবে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনষ্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জরিপের তথ্য বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে মার্চে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ তাদের বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার সার্মথ্য তলানিতে নামছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বলছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাবে প্রায় ৪১ ভাগ মানুষ। ২০১৯ সালে এটা ছিল ২০.৫ ভাগ। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

সে ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির কোন বিকল্প নেই। করোনা পরবর্তী বিনিয়োগ পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে না। তাই সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়া গ্রামীণ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা দিলে বেশি কর্মসংস্থান হবে। উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে কাজের প্রসার ঘটাতে পারলে সেখানেও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সরকারের কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা নিরসন হবে এবং খুব শীঘ্রই আমরা করোনাত্তর পরিস্থিতি মোকবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবো বলে আশা করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনন্যামা নাসুহা করোনায় বাড়ছে শিক্ষিত বেকার মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর