Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপির দ্বিমুখিতা

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার
৮ জানুয়ারি ২০২২ ১১:৫৬

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি বেশ কয়েকবার ক্ষমতার মসনদে বসেছে। বরং সত্য বললে বলতে হয় ক্ষমতার টেবিলেই বিএনপির জন্ম। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। এরপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন দলের দলছুট সুবিধাবাদী নেতাদের সমন্বয়ে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে একত্রিত করে প্রথমে ‘জাগদল’ এবং পরে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বা সংক্ষেপে বিএনপি নামক একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। ক্ষমতার টেবিলে জন্ম নেয়া বিএনপি তাই কোনদিন ক্ষমতা ছাড়া জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হতে পারেনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিএনপি দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে আসছে। তারা শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার জন্য কিছু কিছু ভাসা ভাসা আদর্শ উদ্দেশ্যের কথা প্রচার করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি স্বচ্ছ আদর্শিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা নিজেরা গড়ে উঠতে চায়নি বা উঠতেও পারেনি।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতেও তারা সবসময়ই কিছু হটকারী এবং চূড়ান্ত বিদ্বেষপ্রসূত কার্যক্রম করে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে না হয় দেশে বিদেশে নিজেদেরকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করেছে। কিন্তু তারা নিজেরা কোনদিন ভুল স্বীকার তো করেইনি বা আত্মউপলব্ধিও করেনি। অনেক সময় ঠান্ডা মাথায় খুব বড় অন্যায় করে সামাল দিতে না পেরে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে বিএনপি। জিয়ার শাসনামল থেকেই বিএনপির এই ধরণের কার্যক্রম চোখে পরে। নিজেকে বিরাট মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে এবং আরো কিছু খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে দলে নিলেও জেনারেল জিয়া স্বাধীনতা বিরোধীদের শিরোমনি শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এছাড়াও মাওলানা আব্দুল মান্নান, আব্দুল আলিমসহ সারাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক স্বাধীনতা বিরোধীদের মূল জায়গা হয়ে দাঁড়ায় বিএনপি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান হোতা জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। নিজে কোনদিন ধর্মকর্ম পালনের দিকে না গেলেও ধর্মীয় রাজনীতিকে পুনর্বাসন করেন জিয়া। পক্ষান্তরে বিভিন্ন কায়দায়  মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা অজুহাতে হত্যা করেন। তখন থেকেই জিয়াউর রহমান বা বিএনপির দ্বিমুখীতার চর্চা শুরু।

বিজ্ঞাপন

অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়া যখন ঘোষণা করেছিলেন ‘আই উইল মেক  পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্যা পলিটিশিয়ান’। সেটা পরে তিনি ও তার দল বিএনপি এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছেন। নব্বই দশকের শুরুতে এরশাদ পতনের পর অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসলে আবার নানা ক্ষেত্রে সেই দ্বিমুখীনীতির চর্চা অব্যাহত থাকে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে এরশাদের কথা। সদ্য পতিত স্বৈরশাসক এরশাদের বিষয়ে বেশ কঠোর থাকলে এবং কিছুটা শাস্তি পেলেও তার সহযোগীরা ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী সঙ্গীদের খুব দ্রুতই বিএনপিতে জায়গা করে দেওয়া হয়। যা তখনকার তিনজোটের রূপরেখার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এখানেও বিএনপি বলেছে একটা আর করেছে উল্টোটা। এককথায় বিএনপি ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে থাকতেও কোন সিরিয়াস রাজনৈতিক বিষয়ে বা নীতি নৈতিকতার বিষয়ে স্থির থাকতে পারেনি। এর একটা কারণ হতে পারে তাদের আদর্শের জায়গা ও ভিত্তিটা দুর্বল। একইভাবে ২০০১ সালেও বিএনপি ক্ষমতায় এসে এই দ্বিমুখিতা মানুষের কাছে আরো প্রবলভাবে ধরা পড়ে। বিদেশনীতি বা দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা নিজ দলের মধ্যে কিংবা সরকার পরিচালনায় এর প্রভাব পড়তে থাকে। এবার ক্ষমতায় এসে তো বিএনপি দুটি ক্ষমতার কেন্দ্র খুলে বসে। সরকারের সমানতালে ‘হাওয়া ভবন’ খুলে তারেক রহমান অনেকটা প্যারালাল সরকার পরিচালনা করতে থাকেন। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে যে হয় তা দেশবাসীর কাছে খুব দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও বিএনপির চিন্তার বৈপরীত্ব লক্ষ্য করা যায়। যে চিন্তা থেকে এসব করেছিল ফল হয়েছে বিপরীত। অর্থাৎ বিএনপি যা বলে তা করে না। সে সব কারণে বিএনপি আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। আর ক্ষমতা পাওয়া তো দূর পরাহত।

আর এখনকার বিএনপির অবস্থা তো তথৈবচ। দেড় দশক ধরে ক্ষমতাহারা বিএনপি ‘কি করিলে ক্ষমতায় যাইবে’ এই চিন্তায়ই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সময় পার করছে। এখন অবস্থাটা এমন ‘কি করিলে কি হইবে’ এই অংকই মেলাতে পারছে না। এটা অবশ্য ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই শুরু হয়েছিল। ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে কিনা? সেই নির্বাচনে পরাজয়ের পর সংসদে যাবে কি না? যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে কি করবে? তারেক রহমানকে নিয়ে কি করবে ইত্যাদি করতে করতে সময় পার। তারপর জ্বালাও পোড়াও আগুন সন্ত্রাসের মত আত্মঘাতী আন্দোলন। আন্দোলনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন বয়কট এবং একেবারে সবকিছু গুটিয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়া সব ক্ষেত্রেই বিএনপি কোন স্থির, গঠনমূলক সিদ্ধান্তে আসতে পারে নাই। এরপর যখন আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হবে হবে ভাব তখন বিএনপির নেতৃত্ব আর খালেদা জিয়ার হাতে নেই। বিএনপির পূর্ননিয়ন্ত্রণ তখন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ও দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত পলাতক আসামি হিসেবে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের হাতে। ফল যা হবার তাই হচ্ছে। বিদেশে বসে দল বেঁচে ব্যাবসা করছেন যুবরাজ।

বিএনপির দ্বিমুখীতার চূড়ান্ত রূপ দেখলো দেশবাসী সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে। যে দাবি আদায়ের আন্দোলনে গিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন বয়কট করে দেশব্যাপী আগুন সন্ত্রাস চালালো সেই দাবি আদায় না করেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলো বিএনপি। শুধু কি তাই? যখন দলের দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান একজন দেশের কারাগারে আরেকজন পলাতক আসামি হিসেবে বিদেশ বিভুঁইয়ে, তাদের অনুপস্থিতিতেই নির্বাচনে গেল বিএনপি। যদিও বিএনপি নির্বাচনে গিয়েছিল ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে তারপরও বিদেশে বসে থাকলেও বিএনপির পুরো নমিনেশন প্রক্রিয়া ছিল তারেক রহমানের হাতে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। নিজ দলের একাধিক প্রার্থীর কাছে মনোনয়ন বাণিজ্য করে তারেক রহমান তার গোপন মিশন বাস্তবায়িত করেছে। উদ্দেশ্য ছিল মাকে জেলে রেখে দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়া। নিয়েছেও তাই, এখন একদিন বলে এই নির্বাচনে অংশ নেবো, আরেকদিন বলে ওই নির্বাচনে অংশ নেবো না, ইউপিতে অংশ নিবো না, সিটিতে নেবো, আবার ইউপিতে নৌকা ঠেকাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দেবো। এসবই হচ্ছে তারেকের খেয়াল খুশি মতো। সংসদে যোগ দেয়া শপথ নেয়া নিয়েও তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারেক রহমান কখন কি করছে, কি করবে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। আর এখন তো শুরু করেছে দলের পদ বিক্রি। দলের  পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের হটিয়ে বিপুল অর্থের বিনিময়ে পদ বাণিজ্য করে বিদেশ বসে আরাম আয়েশে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। নিজ দলের এই পদ বাণিজ্যের কারণে খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চাপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীদের গণপদত্যাগের খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। এখানেও স্থির হতে পারছে না বিএনপি, কী করবে দ্বিমুখীতা, হটকারীতা, সিদ্ধান্তহীনতা তাদের কোথায় নিয়ে যায় এই মুহূর্তে তা দেখা ছাড়া দেশবাসীর আর কিছুই করার নাই!

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর