Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতা তুমি জাতির পিতার মুখের বাণী

রহমান মৃধা
১৭ মার্চ ২০২২ ১৩:৪৭

গভীর রাতে টেলিফোন বেজে উঠল, সুইডেনে রাত তখন ৩টা হবে। এত রাতে টেলিফোন! রিসিভার না নেওয়া পর্যন্ত বুক ধড়ফড় করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভার তুলে বললাম, হ্যালো। ক্যাটরিনের গলা শোনা গেল, দুঃখিত, রহমান! এখন যে তোমার ওখানে রাত ভুলে গিয়েছি। বললাম ব্যাপার কী? সে বলল, ডাল কি করে রান্না করতে হয় তা ভুলে গেছি, তাই তোমাকে ফোন করলাম। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। টেলিফোন করেছে আমার এক আমেরিকান বান্ধবী। সে সুইডেনে গেস্টস্টুডেন্ট হয়ে লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে ১৯৮৫ সালে। আমরা একই ডরমিটরিতে থেকেছি দুই বছর। মাঝের মধ্যে বাংলা খাবার খেয়েছে আমার সঙ্গে। রাতদুপুরে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের অদূরে, সান্তা মনিকা থেকে ফোন করেছে কীভাবে ডাল রান্না করবে তা জানতে। আমি চুপ করে রইলাম। ক্যাটরিন বলে, কাল ৭ মার্চ তাই মনে করেছি কিছু বন্ধুকে তোমার মতো করে ডালভাত খাওয়াব। আমি শীতল গলায় বললাম, ঘটনা কী? বাংলাদেশি কারো প্রেমে পড়েছ নাকি? আরে না তুমি ৭ মার্চ পালন কর তাই। সর্বনাশ, এতক্ষণে আমার ঘুম ভাঙল। যাই হোক ক্যাটরিনকে সহজভাবে বলে দিলাম ডাল রান্নার পদ্ধতি। সে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলল এবং এও বলল, রাতে টেলিফোন করবে খাবার শেষে। আমি টেলিফোন রেখে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা হবে। এক কাপ কফি তৈরি করে তা নিয়ে বসে গেলাম সুইডিশ নিউজ পেপার পড়তে। কফি শেষ করে বড় ভাইকে ফোন করলাম।

বিজ্ঞাপন

আমার বড় ভাই মান্নান মৃধা তখন পিএইচডি স্টুডেন্ট। আমাদের প্রথম থেকেই পরিকল্পনা রয়েছে এবার বাংলাদেশ ইভিনিং পার্টি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বললাম, প্ল্যানপ্রোগ্রাম নিয়ে আপনার সঙ্গে আরেকবার বসা দরকার; কারণ এবার অনেক লোক হবে, তারপর স্টকহোম থেকে বাদ্যযন্ত্রসহ কিছু বাংলাদেশি, আমাদের রাষ্ট্রদূত এবং তার পরিবার অনুষ্ঠানে থাকবে। মান্নান ভাই বললেন, টেনশন করো না সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, এখনও তো দেরি আছে। আমি বললাম, দেরি আপনি কোথায় দেখলেন? কয়েক ঘণ্টা মাত্র বাকি। শালাদের একটা ভেলকি দেখিয়ে দেব না? বাংলাদেশ বললে চিনতে পারে না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছা করে আমাদের দেশটাকে না চেনার ভান করে। এবার শালারা বুঝবে বাংলাদেশ কী জিনিস!

বিজ্ঞাপন

একই সঙ্গে পাকিস্তান এবং ভারতের শিক্ষার্থীদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে, যখন দেখবে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। সবাই অবাক! স্টকহোম থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালিরা আসতে শুরু করেছে। চুপচাপ হয়ে সবাই বসে আছে, মাঝে মধ্যে আমি গম্ভীর গলায় মান্নান ভাইকে বলছি, শালারা ভাবছে এখন বাংলাদেশ কী জিনিস। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। আমি আরও কয়েকটি গান গেলাম, তবে সুন্দর গেয়েছিলাম জাতীয় সংগীতটি। মান্নান ভাই কবিতা আবৃত্তি করলেন। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের ওপর কিছু বললেন। বিদেশবিভুঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্য অনেকেরই বুক হুহু করতে লাগল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্য অনেকে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হলো। সবাই বেশ মজা করেই খেল।

শীতের সময় (নভেম্বরএপ্রিল) এখানে প্রায়ই সূর্যের দেখা মেলে না, তবে মার্চ মাসের শীতের দিনগুলো বেশ বড় হতে শুরু করে। সূর্য সন্ধা ৬টার আগে ডুবে না। চলছে চাকফির আড্ডা। সব শেষে বিদায়ের পালা। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলল, অনুষ্ঠানের পুরো খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে। সবাই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম এবং মান্নান ভাই মনে হলো একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। পরে সুইডিশদের কাছ থেকে শুনেছি, আমাদের অনুষ্ঠানটি ওদের খুবই পছন্দ হয়েছিল এবং সেই থেকে লিনসোপিংয়ে অনেকের মুখে মুখে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ।

এ ঘটনার পরে আমাকে একবার এক পাকিস্তানি প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল, আমরা যদি তাদের সঙ্গে একত্রে একটি অনুষ্ঠান করি তাহলে কেমন হয়? কেন যেন তখন বারবার মনে হয়েছিল না কখনো না, যারা আমাদের মাবোনদের ধর্ষণ করেছে তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠান? যাই হোক পরদিন লিনসোপিংয়ের পত্রিকায় বাংলাদেশ ৭ মার্চ সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হয়। খবরের অংশবিশেষ এ রকম ছিলএকটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।

স্মৃতির জানালা খুলে মন ভরে দূরপরবাস থেকে সেই বহু বছর আগের দৃশ্যগুলো চোখে ভাসছে আজও। যেমন ব্রিটিশ আর দেয় না হানা, নেই তো পাকিস্তানের অত্যাচার। তারপরও প্রতিদিন শুনি দেশজুড়ে শুধু ধর্ষণ, ভণ্ডামি আর গুণ্ডামি। ভেবেছিলাম দেশ তো স্বাধীন, এখন সবাই ভালোই আছে। কিন্তু এখনও অনেকে একমুঠো ভাত খেতে পায় না, এটা কি তাহলে আমাদের ব্যর্থতা! কী কঠিন সংগ্রাম করে দেশটিকে সবাই মিলে স্বাধীন করেছিলাম। আর আজ দেশে ধর্ষণ, হত্যার খবর আমাদের বিচলিত করে। আমরা ১৯৭১ সালে শপথ নিয়েছিলাম সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করতে। আমি দূরপরবাস থেকে এখনও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেন আমরা আমাদের সংবিধানের মর্যাদা রাখতে পারি।

যে বিষয়টি বেশি মনে পড়ছে সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। দেশ মুক্তি করেছি বিদেশিদের হাত থেকে, দেশ স্বাধীন করেছি। এখন দায়িত্ব নিয়ে দেশকে গড়তে হবে। আমি আমার জায়গা থেকে দায়িত্বের সাথে চিৎকার করে বলতে চাই, আমি দুমুঠো ভাত, পরনে বস্ত্র, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, বাসস্থান এবং শিক্ষা চাই। আমাকে আগে আমার এই নূন্যতম চাহিদাটুকু পূরণ করতে সক্ষম হতে হবে। দেশের মানুষকে বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে শেষ করে আমরা স্বাধীনতার পতাকা উড়াবো আর অন্যদিকে মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বে বেঁচে থাকার জন্য তা কীভাবে সম্ভব? আমার দেশে কালো পতাকা উড়বে লাল সবুজের পতাকার পাশে একই সময় সেটা কি ভালো দেখাবে? হয়ত কথা উঠতে পারে কি হচ্ছে ইউরোপে? পুতিনের ইউক্রেন হামলার নিন্দা আমরা সবাই করছি ঠিকই কিন্তু আমেরিকার মত ইউরোপেও বিশ্বের সব দেশের মানুষের বাস সেখানে। তবে বোঝা যায় এখানেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রয়েছে। ধনীগরীব, ভাষাসংস্কৃতি, ধর্মবর্ণ এগুলো বিশ্বের সর্বত্র বড় আকারে প্রভাব ফেলে চলেছে। আমরা দিন দিন গ্লোবালাইজড হচ্ছি আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছি। আমি প্রায়ই বলে থাকি “to be poor is very expensive”। গরীবের না আছে বন্ধু, না আছে অর্থ। সেক্ষেত্রে সমাজের চোখে সব সময় অবহেলিত, নির্যাতিত এবং হেয় প্রতিপন্ন হয়।

বাংলাদেশে ভাষা, বর্ণ ও ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও গরীব হবার কারণে সমাজে এদেরকে তেমন ভালো চোখে দেখা হয় না। আবার একই ভাষা বুকের মাঝে সত্ত্বেও ধর্ষণ, গণহত্যা এবং শেষে মরদেহকে দিবালোকে পুড়িয়ে ফেলতেও বিবেকে কোন বাঁধা নেই। হিংসাত্মক ক্ষমতাবান বৈষম্যবাদী পুঁজিবাদের অন্ধকার হৃদয়কে গ্রাস করেছে। দেশে হত্যার উল্লাসে অনেকে উল্লসিত। মনে হচ্ছে সকলেই কোনো না কোনো ঘৃণার নেশায় নিমজ্জিত। সকলেই হয় আত্মঘাতী, নয়তো পরঘাতী। অনেকের ধারণা রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইনপ্রশাসন ঠিক না করলে মানুষের আচরণ বদলাবে না। দেশের মানুষই যখন ভুলের মাঝে ডুবে আছে, তখন রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন, প্রশাসন ঠিক করবে কারা? বিশ্বের অনেক দেশেই একই অবস্থা। তাছাড়া ধর্ম এবং বর্ণের অমিলে পাশ্চাত্যে হেয় প্রতিপন্ন হবার সম্ভাবনা একটু বেশি। সমাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলে পার্থক্যটা এতটা চোখে পড়ে না। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ফ্রান্সে। এদের মোট লোকসংখ্যার মধ্যে প্রায় এক কোটি মুসলমান। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকারের উচিত হবে না মুষ্টিমেয় বা কতিপয় কিছু মুসলমানদের অমানবিক ব্যবহারের কারণে পুরো মুসলিম জাতিকে অবমাননা করা অথচ এমনটিই ঘটে চলেছে। ভারত এবং চীনে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর অমানবিক দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব দেখছে অথচ তেমন কিছুই করছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। তবে জর্জরিত, নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। হঠাৎ যখন একটি অঘটন ঘটে, সবাই উত্তেজিত হয়ে কিছুদিন হৈহুল্লোড় করে, পরে সবকিছু শীতল হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না, যার ফলে নিপীড়িত নির্যাতিতের সংখ্যা বেড়ে চলবে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ তেমন কিছু করছে না। সবাই বলতে আমার দৃষ্টিতে যাদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদেরকেই আমি দোষারোপ করছি।

মনে রাখা দরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতা এক নয়। মতামত ব্যক্তির মনের মধ্যে সব সময় লুকিয়ে থাকতে পারে না। মতামত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং জ্ঞানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে বিবেক বা চিন্তাচেতনা। নানা কারণে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ সব সময় ঘটে না। তবে চিন্তার যোগ্যতা এবং স্বাধীনতা ছাড়া কেউই দুনিয়ায় তাদের অধিকার কায়েম করতে পারে না। সেক্ষেত্রে দরকার বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকার। আমাদের অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা উচিত। তবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই সীমারেখা থাকতে হবে এবং তা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। আমাদের অন্যদের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে। ধর্মবিদ্বেষ অসুস্থ মতপ্রকাশের বিকার, চিন্তার স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে সাহায্য করে। আমাদের কাজ হওয়া উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে যেটা সঠিক সেটা মেনে চলা।

আমি যেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেটা যদি অন্য কেউ না করে সেখানে জোর করার কিছু থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে যার যার ধর্ম তার তার কাছে থাকা ভালো। অন্যের ধর্মকে ছোট করা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের কাজ নয়। তাই আসুন ঘৃণা নয় ভালোবাসা দিয়ে জয় করি এবং জয়ী হই। স্বাধীনতার মাস হোক পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার মাস।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন

সারাবাংলা/এসবিডিই

রহমান মৃধা

বিজ্ঞাপন

কেন বিয়ে হচ্ছে না উর্বশীর?
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:২৫

আরো

সম্পর্কিত খবর