ইতিহাসের মহানায়কের জন্মদিন আজ
১৭ মার্চ ২০২২ ১৬:২৫
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, মঙ্গলবার। সেদিন রাত ৮টার দিকে মা সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করে আসেন ইতিহাসের মহানায়ক; বাঙালি ও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার সেই অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন আজ। গোপালগঞ্জ জেলার ঘাঘোর ও মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মহান এই নেতা। পিতা শেখ লুৎফর রহমান চাকরি করতেন গোপালগঞ্জ আদালতে। মাতার সায়েরা খাতুন ছিলেন ধার্মিক ও আদর্শ গৃহিণী। ইরাক থেকে আগত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-পুরুষরা। শেখ আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন বাগদাদের হাসানপুর নামক স্থানে।
বঙ্গবন্ধু কর্মে ও নেতৃত্বে বাঙালির হৃদয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতির নাম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন কালক্রমে। বাংলাদেশের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে এ দেশের মানুষ যাকে মর্যাদার আসনে অলংকৃত করে রেখেছেন যুগযুগ ধরে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই একটা আলাদা মানচিত্র ও পতাকা পেয়েছে বাংলাদেশ। হয়ত সেজন্য কোটি কন্ঠে অকুতভয়ে বারবার গেয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু মানেইতো বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানেই মুক্তিযুদ্ধ। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না। তাইতো যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন মানুষের মনিকোটায় থাকবেন প্রিয় বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন। যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালের যে দুটো দালান বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে-দুটোই জ্বালিয়ে দেয়। এই দালান কোঠায় বসবাস শুরু হবার পর ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানেই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফরর রহমান এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন।’
বঙ্গবন্ধুর সব আন্দোলনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাঙালি জাতির জাতিসত্তার ওপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদমুখর হয়ে সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০-এর নির্বাচন- যখনই বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে এসেছে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বজ্র কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে তখন তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও জাতীয়তাবাদকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন।
অল্পবয়স থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে রক্ষণশীল কট্টরপন্থী নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্তৃত্ব খর্ব করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। পঞ্চাশের দশক তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন দূরদর্শীতা এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা।
এসময় শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি মন্ত্রী হন মুজিব। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
১৯৬৩ সালে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। তিনি ছিলেন আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্বের কট্টর সমালোচক। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করেন তাঁকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার সবজনগণ। জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে এক পর্যায়ে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শোষকগোষ্ঠী। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেখান থেকেই উত্থাপিত হয় এগার দফা দাবি যার মধ্যে ছয় দফার সবগুলোই অন্তর্ভুক্ত ছিল। লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। … একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। … জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিলো। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। শেখ মুজিব তখনই বুঝে যান যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
অগ্নিঝড়া ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃংখল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। … প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে”।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা। মুজিবের নেতৃত্বে বাঙ্গালি জাতির এই জাগরণে ভীত ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, নিষিদ্ধ করেন আওয়ামী লীগকে এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন গ্রেফতার করেও আর দাবিয়ে রাখতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনায় গড়ে তুলা মুক্তিকামী বাঙালীকে। রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বাঙালী চিনিয়ে আনেন তাদের মহান স্বাধীনতা।
তারপর ১৯৭২। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটান। কিন্তু তার পরের ইতিহাস বাঙালি জাতির অন্ধকার যুগের ইতিহাস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অবৈধভাবে সামরিক জান্তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। সংবিধানে একের পর এক অবৈধ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭২’র সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানি চেতনার আলোকে একের পর এক সংশোধনী আনা হয়। পাকিস্তানি পরাজিত শক্তির দোসরদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রোপণ করা হয়। সমাজ এক ভুল ইতিহাস ও মূল্যবোধের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। ইতিহাসের বিশাল এক সময় ধরে চলে এই অধঃপতন।
যদিও বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে নিয়েছে কঠোর পদক্ষেপ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে এসে দেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বঙ্গবন্ধু কণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশরত্ন শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের শিখরে। বস্তুত সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। এই ভূখণ্ডের মানুষদের সংগ্রামমুখর জীবন, মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রত্যয়ে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় পদক্ষেপ বিশ্বকে সময়ে সময়ে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে প্রিয় এই বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি