জাতির রাজনীতি তার ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি
২২ মার্চ ২০২২ ১৬:৫৮
রাজনীতি করি মানে দুর্নীতি বা অনীতি করতে হবে তা নয়, রাজনীতি অর্থ সেবা দেয়া এবং সেটা জনগণের জন্য হতে হবে। জনগণ যাকে এ দায়িত্ব দিবে তাকেই সেটা পালন করতে হবে। একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদের কাছে রাজনীতি একটি পেশা এবং সেবা দেয়ার নেশা। তার মধ্যে থাকবে প্যাশন বা গভীর আবেগ। দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা এবং অনুপাত-সম্পর্কিত জ্ঞান।
রাজনৈতিক নেতার সামনে একটি ‘কারণ’ থাকতে হবে। তাকে শুধু ক্ষমতার জন্য বুভুক্ষু থাকলে হবে না। একজন রাজনৈতিক নেতার থাকতে হবে নৈতিক মেরুদণ্ড এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা। এর সঙ্গে যখন বিচার করার যোগ্যতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা যুক্ত হবে, তখনই একজন রাজনৈতিক নেতা ইতিহাসের চাকার দিক পরিবর্তনের সক্ষমতা অর্জন করবেন।
মহৎ উদ্দেশে রাজনৈতিক নেতা হবেন বাস্তববাদী। এই কৌশলে দারিদ্র হ্রাসে, মানব উন্নয়নে, টেকসই বিনিয়োগ, নারীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং মানবাধিকার উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অন্তর্ভুক্ত করবেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা ও বিজ্ঞান সচেতন করে জনগণকে গড়ে তুলতে সব ধরনের সু-শিক্ষামূলক পদক্ষেপ নিবেন, যাতে করে আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।
আমাদের সমাজে তথা বাংলাদেশে রাজনীতি বাপ-দাদা চৌদ্দ-গোষ্ঠীর পৈতৃক সম্পদে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি হয়েছে কাইন্ড অফ হেভি ইনভেস্টমেন্ট ইন্সটিটিউশন, যেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পদবি দখল করার প্রবণতা (যে কোন মূল্যে)। তারপর চলছে শাসন এবং শোষণ।
যদি দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঠিক চর্চা হতো, যদি সু-শিক্ষা এবং নৈতিকতা (moral value) বলে কিছু থাকত, তবে গণতন্ত্রের পতন হতো বলে মনে হয় না। এখন যদি সত্যিকারে গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস শুরু করতে হয় তবে প্রথমত জানতে হবে রাজনীতি কী। দ্বিতীয়ত সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আমার দেখা এবং জানা মতে সেটা সম্ভব যদি আমরা সুইডেনের রাজনীতির পরিকাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফলো করি।
সুইডেনে মোনার্কি থেকে ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের যে আবির্ভাব হয়েছে যা গোটা বিশ্বের জন্য জানা এবং শেখার বিষয়। এখানে রাজনীতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা যেমন, রাজনীতির মূল অর্থ ‘রাষ্ট্রীয় শিল্প’ এবং সাধারণত জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত পদক্ষেপ এবং ক্রিয়াকে বোঝায়। এবং জনসাধারণের বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকাণ্ড এবং সংগঠন পর্যন্ত সমস্ত কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে।
বাংলাদেশের মানুষের মাইন্ডসেট এবং নৈতিকতার পরিবর্তন হোক সেটা আমি মনে প্রাণে আশা করি তাই সুইডেনের একটি ট্রু লাভ -এর ওপর বাস্তব ঘটনা শেয়ার করব যা নিশ্চয় সবার ভালো লাগবে। প্রশ্ন আসতেই পারে রাজনীতির ওপর আলোচনা করতে ‘ট্রু লাভ’ ঢুকানোর কারণ কি? কারণ জাতির রাজনীতি তার ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। ঘটনাটি নতুন নয়, আমি জানতাম অনেক আগেই কিন্তু আজ মনে হলো বিষয়টি শেয়ার করি। সত্যিকারার্থে রাজনীতি, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এসব নিয়ে লিখতে লিখতে অনেক সুন্দর সুন্দর ঘটনার কথা লিখা হয়নি। তবে কথায় বলে ‘নেভার ঠ্যু লেট’ তো আসুন জানি একটি ভালোবাসার নিদর্শন। সততা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে বাস্তব পরিপূর্ণতা লাভ করা যায়, সুইডেনে চলছে এর ওপর বেস্ট প্রাক্টিস। সঠিক রাজনীতির চর্চার মত ভালোবাসার ওপরও সুন্দর চর্চার দরকার। আমার মতে রাজনীতি এবং ভালোবাসার বেস্ট প্রাক্টিস পৃথিবীর অন্য কোথাও সুন্দর ভাবে না হলেও সুইডেনে যে হচ্ছে, এটা আমি বলতে পারি। একটি চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরি সুইডেনের প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়ার ভালোবাসা দিয়ে।সুইডেনের বর্তমান রাজার অবর্তমানে ভিক্টোরিয়া রানী হবেন এবং ইতিমধ্যে তিনি নানা কর্ম-কান্ডের সাথে জড়িত হয়েছেন। ভিক্টোরিয়া তাঁর ব্যক্তিগত ফিটন্যাস ট্রেনারের প্রেমে পড়েন যৌবনের কোন এক সময়। একজন অতি স্বাধারণ পরিবারের সন্তানের প্রেমে পড়া এবং বিয়ে করা, শেষে সুইডেনের ভবিষ্যত রানীর স্বামী এবং সবার প্রিন্স, ভাবতেই গা শিউরে উঠার কথা। কিন্তু সুইডিশ জাতি সব কিছুর উর্ধে ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়ার ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়েছে, কোন রকম জটিলতা ছাড়া। আমাদের দেশে এমনটি যে হতে পারে ভাবতেও ভয় হয়! প্রিন্স ডানিয়েল দিব্বি সব কিছু মানিয়ে, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, রাজ প্রাসাধে জীবন-যাপন করে চলছেন। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া এবং ডানিয়েল দুই সন্তানের মা-বাব। এইতো সেদিনের কথা আমার ছেলে টেনিস প্রার্টিস করছে হঠাৎ ডানিয়েল সেখানে হাজির, দাড়িয়ে মনের আনন্দে দেখছে জনাথানের খেলা। আমাকে দেখে তাঁর বুঝতে সমস্যা হয় নি যে আমি তার বাবা। জাস্ট হাই হ্যালো মিনিময় হলো কোন রকম জটিলতা ছাড়া। এসব ঘটনার সঙ্গে যখন নিজেকে জড়িয়ে ফেলি তখন স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে এবং তখন মনে হয় কবে হবে এমনটি আমাদের দেশে!
আমি মাঝে মাঝে গান গাই এবং গান শুনিও। অনেক দেশের ভাষা বুঝিনে, গানের মানে বুঝিনে, তারপরও যদি সে দেশের গান কখনও শুনি ভালোই লাগে। কারণ আমরা মানুষ জাতি বনফুলের মত ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে যখন হৃদয়ে ভালোবাসা দোলা দেয়। ভালোবাসা সত্যিই স্রষ্ঠার দেওয়া নিয়ামত যার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা। সব ভালো কাজের মধ্যেই রয়েছে ভালোবাসা। যে কথা বা কাজে মজা নেই, তাতে ভালোবাসাও নেই। গানে যেমন মজা আছে, দরদ আছে, ভালোবাসা আছে, তাই গানের মানে না বুঝলেও ভালো লাগে। কিন্তু চুরি করা, ধর্ষণ করা, দুর্নীতি করা, কাওকে ছোট করে কথা বলা বা অন্যায় করা এর মধ্যে মজা আছে বলে আমার মনে হয় না বা এগুলো করলে যে ভালোলাগে বা ভালোবাসা জাগে তাও না, তারপরও আমরা এসব কাজ করি। যখন কিছু করলে মনের মধ্যে ভালো না লাগে বা হৃদয়ে ভালোবাসার সৃষ্টি না হয়, তাহলে কেনো সে কাজ গুলো আমরা করি? হয়ত অনেকে বলবে পেটের দায়ে বা প্রয়োজনের তাগিদে অন্যায় করি! কিন্তু কিছু কিছু ভালোবাসা রয়েছে যা একান্ত হৃদয় ছোয়া এবং ভালোলাগা থেকে সৃষ্টি, তারপরও সে ভালোবাসা অনেক সময় বেদনাদায়ওক হয়, যেমন একজন কোটি পতি বাবা-মার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে একজন গরীবের ছেলের প্রেম। ধনীর সঙ্গে গরীবের প্রেম শতভাগ সত্য হলেও পরিবার তথা সমাজের চোখে সেটাকে সন্দেহভাজন বলা হয় শুরুতেই, অর্থের ব্যবধানের কারণে সমাজ সে ভালোবাসার মূল্যায়ন করে না, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত সমাজে। এ ধরণের ডিসক্রিমিনেশন রয়েছে কম বেশি বিশ্বের সর্বত্র তবে বাংলাদেশে তুলনামূলক ভাবে বেশি লক্ষনীয়। যদিও কুমার বিশ্বজিতের কন্ঠে শুনেছি, ‘বলতো ভালোবাসা কারে বলে, বলতো এ হৃদয় কেন জলে, ভালোবাসি অত শত বুঝিনা’ – কবে হবে এই গানের কথা সত্যিকার মনের কথা এবং কবে হবে বাংলাদেশে সুইডেনের মত গণতান্ত্রিক নৈতিকতা!
লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি