বটিয়াঘাটা অঞ্চলে পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণ- চকরাখালি গণহত্যা
৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:১২
একাত্তরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা জেলাটি সবচেয়ে বেশি গণহত্যা প্রবণ এলাকা ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৮ মার্চের থেকেই মূলত খুলনা শহর এবং আশেপাশের এলাকায় অভিযান শুরু। এ জেলার মধ্যে বটিয়াঘাটা উপজেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। এ উপজেলার প্রথম গণহত্যা ছিল ২৪ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা গণহত্যা সংগঠিত চকরাখালী গণহত্যা। এ গণহত্যায় আনুমানিক ৪ জনের অধিক শহিদ হয়েছিল, তবে ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে এ গণহত্যার ভয়াবহ ব্যাপকতা ছিল।
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল শনিবার ছিল সাপ্তাহিক হাটের দিন। জলমা চকরাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে এই হাট বসত। বেলা দুটোর দিকে কয়েকজন দোকানদার তাদের দোকান খুলে দোকান সাজানোর কাজ করছিল। তখন কেবল শতাধিক মানুষের সমাগম ঘটেছে মাত্র। হঠাৎ কাছিবাছা নদীতে জলপাই রঙের দুটি গানবোট দেখে লোকজনের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হল। গানবোট দুটি চকরাখালী স্কুলের সামনে এসে গতি কমিয়ে থেমে যায়। গানবোট থামা মাত্রই পাকিস্তান বাহিনী পজিশন নিয়ে চকরাখালী স্কুল অভিমুখে গুলি শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাদের নিকট খবর ছিল যে স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প রয়েছে। ফলে সেনারা স্কুল ভবন লক্ষ করে প্রায় বিশ মিনিট গুলি করে। কিন্তু প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোনো ধরনের বিপরীত আক্রমণ হয় না। এদিকে গুলির শব্দে চারিদিকে আতঙ্ক বিরাজ করে এবং মানুষ প্রাণভয়ে গ্রামের পশ্চিম দিকে ছয়ঘরিয়া গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চকরাখালী বাজারটি জনশূন্য হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ গুলি পর বিপরীত দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় গুলি করা বন্ধ করে দেয়। এরপর গানবোট থেকে নৌকাযোগে আনুমানিক ৩০-৪০ জন পাকিস্তান সেনা চক্রাখালী গ্রামের টিকাদার বাড়ির ঘাটে নামে। এই সময় হানাদারেরা ঠিকাদার বাড়ির কালীপদ ঠিকাদারের বাড়িতে আগুন দেয় এবং তাঁকে গুলি করতে উদ্যত হয়। পরে তাঁকে বাড়ির পাশ্ববর্তী রাস্তার পাশে এনে পেটে বেয়নেট বিদ্ধ করে। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর মারা যান। এরপর পাকিস্তান বাহিনী কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে অপারেশন পরিচালনা করে। একটি দল চকরাখালী স্কুলে প্রবেশ করে স্কুলের ভবনে বোমা হামলা করে এবং অফিসের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। আরেকটি দল স্কুলের দক্ষিণ দিক থেকে আগুন দিয়ে পোড়াতে পোড়াতে নিরঞ্জন কুমার রায়ের বাড়ির দিকে প্রবেশ করে। তাঁর বাড়ির সকলে পালিয়ে গেলেও ৮০ বছরের বৃদ্ধ ধনঞ্জয় রায় পালাতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনারা তার বুকে রাইফেল ধরে গুলি করতে উদ্যত হলে বৃদ্ধ ধনঞ্জয় রায় প্রাণভিক্ষা করেন। হানাদারেরা তাঁকে গুলি না করে চলে যায়।
পাকিস্তান সেনারা চকরাখালী গ্রামের পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বাড়িঘর, মন্দির পোড়াতে থাকে। সামনে যাকে পেয়েছিল, তাকেই রাইফেল দিয়ে আঘাত করে, বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়, কাউকে গুলি করে। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা নিকটতম গ্রাম ছয়ঘরিয়া, রাঙ্গেমারী এবং দরগাতলায় আশ্রয় নেয়। আশ্রিত গ্রামবাসীদের অনেকে জীবন বাঁচাতে হোগলাবনে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁদের শেষ রক্ষা হয়নি। হোগলাবনে এলোপাথাড়ি গুলিতে অনেকে মারা যায়। সেখানে পাকিস্তান সেনারা গোপালকে পেঁটে গুলি করে। এতে তাঁর নাড়ি-ভূঁড়ি বের হয়ে যায়। স্বজনদের চোখের সামনেই গোপালের মৃত্যু হয়।
চকরাখালী গ্রামের অধিবাসী রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ঢালীখালের কাছে বাড়িতে ফিরছিলেন। তাঁর হাতে ওড়াকান্দীর শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের দেয়া কালো রং এর লাঠি ছিল। পাকিস্তান সেনারা তাঁকে প্রতিরোধকারী ভেবে সাথে সাথে গুলি করে। মুহূর্তেই তিনি নিজের জমিতে প্রাণ ত্যাগ করেন। এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ঢালীখালের লম্বা হোগলাবনকে লক্ষ্য করে পাকিস্তান সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। হোগলাবনে লুকিয়ে থাকাদের মধ্যে চন্দ্রকান্ত রায়ের ডান চোখ ঘেঁষে মাথায় গুলি লাগে। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এরপর সেনারা ভেটকমারী খাল পার হয়ে নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা করে। তাঁর পিতা, পিতামহ এবং বোনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে পরিবারটি রক্ষা পাই। এরপর আবারও সেনারা চকরাখালী স্কুলের দিকে ফিরে আসে। তবে ফেরার পথেও পুরা গ্রামে আগুন দেয়।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বটিয়াঘাটা অঞ্চলে পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণ- চকরাখালি গণহত্যা মুক্তমত মো.রিয়াদ হোসেন