স্তন ক্যান্সার রোধে সচেতন হতে হবে
৭ এপ্রিল ২০২২ ১৪:৩৬
ক্যান্সার কথাটি শোনামাত্র সবার মনে ভয় কাজ করে সৃষ্টি হয় এক বিভীষিকার। পৃথিবীতে যত ধরণের ক্যান্সার আছে এর মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ব্রেস্ট ক্যান্সারে এবং মারা যাওয়ার হার ও বেশি। বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই স্তন ক্যান্সারের রোগী। এই রোগের প্রকৃত সংখ্যা কত- তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো তথ্য নেই। তবে প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত ১৫ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ১৫ লক্ষাধিক নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং প্রতি লাখে ১৫ জন নারী মারা যান। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে (ক্যান্সার রেজিস্ট্রি) স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা রেকর্ড করা না হলেও, পার্শ্ববর্তী দেশের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার নারী নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
চিকিৎসকের মতানুসারে আমাদের শরীরের যেকোনো স্থানের কোষগুলো যখন খুব দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন সেগুলো একটি অস্বাভাবিক চাকা বা পিণ্ড তৈরি করে। এ ধরনের চাকা বা পিণ্ডকে সাধারণ ভাষায় টিউমার বলা হয়। টিউমার দুই ধরনের হতে পারে, বেনাইন বা অক্ষতিকর এবং ম্যালিগন্যান্ট বা ক্ষতিকর। বেশির ভাগ স্তন টিউমারই বেনাইন; মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যাকে আমরা ক্যানসার বলে থাকি।
আমাদের দেশের নারীরা তাদের নিজের শরীরের রোগ নিয়ে এমনিতেই অবহেলা করেন এবং গোপন অঙ্গের রোগের কথা সহজে কাউকে বলতে চাই না ।ফলে তারা স্তন ক্যান্সারের মত জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্তন ক্যান্সার কারণ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। সেগুলো প্রত্যেক নারীর জেনে রাখা খুবই জরুরি। স্তন ক্যান্সার অপরিবর্তনযোগ্য কারণগুলো:
১. বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
২. জেনেটিক কারণে স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ে। BRCA1 এবং BRCA2 জিন মিউটেশনের ফলে স্তন ক্যান্সার হতে পারে।
৩. একই পরিবারের দুজন বা তার বেশি নিকটাত্মীয়ের স্তন ক্যানসার থাকলে অথবা একই পরিবারের সদস্যদের স্তন বা ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকলে কিংবা ৪০ বছরের কম বয়সী একজন নিকটাত্মীয়ের স্তন ক্যান্সার থাকলে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে।
৪. মহিলাদের যদি ঋতুস্রাব খুব অল্প বয়সে শুরু হয় এবং ঋতুস্রাব বন্ধ যদি খুব বেশি বয়সে হয়ে থাকে, তাহলে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের সঙ্গে মহিলাদের সংস্পর্শ অনেক বেশি দিন ধরে হয়। তাই এ রোগের সম্ভাবনাও বাড়ে।
৫. পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৬. পূর্বে রেডিওথেরাপি পেয়ে থাকলে স্তন ক্যান্সার সম্ভাবনা বাড়ে।
৭. তা ছাড়া যেসব নারীর এক স্থানে ক্যান্সার হয়েছে, তাঁদের অন্য স্থানে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এছাড়া বেশি বয়স পর্যন্ত বিয়ে না করা, সন্তান না নেওয়া বা সন্তানকে নিয়মিত বুকের দুধ না খাওয়ানো, অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রম একেবারেই না করা, গর্ভনিরোধক ওষুধ ও অ্যালকোহল পান স্তন ক্যানসারের কারণ।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়তে থাকে তাই একটি নির্দিষ্ট বয়স পর থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ।
সামজিক রক্ষণশীলতার জন্যে আমাদের সমাজের নারীরা স্তন শব্দটি মুখে আনতে চাই না তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে সেইটা তারা গোপন রাখে। স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ কোনো নারী বুঝতে পারলেও সেইটা নিয়ে সচেতন না। আবার দেখা যায় কোনো মহিলা যদি তার স্বামীকে তার সমস্যার কথা বলে তার স্বামীও এটা নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না এবং একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তখন কিছুই করার থাকে না। আর সেজন্য স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো জানা খুবই প্রয়োজন। যেমন-স্তনের বোটা থেকে কিছু বের হওয়া, স্তনের ভিতর চাকা অনুভব করা, স্তনে ব্যাথা অনুভব করা, স্তনের আকার পরিবর্তিত হওয়া, স্তনের ত্বকে ঘাঁ দেখা দেওয়া, স্তনের ত্বকে লালচে ভাব/দাগ দেখা দেওয়া।
উপরের লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরার্মশ অত্যন্ত জরুরি যা স্তন ক্যান্সারের ভয়াবহতা ও মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে।
স্তন ক্যান্সার সাধারণত দুভাবে শনাক্ত করা যায়: ১. স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ২. রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে।
স্ক্রিনিং আবার দুভাবে করা যায়: ১. নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করা। ২. ডাক্তার বা নার্সের সাহায্যে পরীক্ষা করা। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও প্রধানত দুটি পদ্ধতি রয়েছে: ১. মেমোগ্রাম বা স্তনের বিশেষ ধরনের এক্স রে। ২. স্তনের আলট্রাসনোগ্রাম।
তাছাড়া এমআরআই এবং বায়োপসি এর মাধমেও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশের অনেক নারী আছেন যারা স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে জানেনই না এবং যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছান তখন তিনি জানতে পারেন যে তার এই রোগ হয়েছিল। স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে যদি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করা হয় তবে অনেক রোগী দ্রুত সুস্থ হয় ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে এই কথাটি প্রত্যেক নারীর জানা জরুরি। লজ্জা না পেয়ে স্তন ক্যান্সারকে রোগ হিসাবে মনে করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক। বিভিন্ন টকশো, লিফলেট, সেমিনারের আয়োজন করে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
গবেষণায় দেখা যায়- প্রতি ৮ জনে ১ জন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনসমষ্টি দরিদ্র তাই কোনো পরিবারে কারো ক্যান্সার হলে সেটি ওই পরিবরের জন্যে দুর্যোগ ডেকে আনে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করতে পারলেও দেখা যায় শুধুমাত্র ব্যয় বহন সামর্থ্য না থাকার ফলে অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যান না। আমাদের দেশে দেখা যায় ডাক্তারের কাছে গেলেই অনেক অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করা হয় যার ফলে অনেক লোক ডাক্তারের কাছে যেতেই ভয় পায়, তাই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে স্তন ক্যান্সার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, ব্রেস্ট কেয়ার স্থাপন করতে হবে, রেডিয়েশন থেরাপির কেন্দ্র বাড়াতে হবে, মেডিকেল অনকোলজিতে দক্ষতা বাড়াতে হবে যেন অর্থের অভাব জন্যে কেউ চিকিৎসা নিতে ভয় না পান।
স্তন ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের একটি সমস্যা হলো এটি একটি চাকা যার ব্যাথা নেই রক্তপাত হয় না যার ফলে আমরা সাধারণত যে সব রোগের লক্ষণ প্রকাশ হলে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যাই তার কোনটাই স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ঘটে না তাই নিজে সচেতন না হলে এই ভয়াল রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব না তাই সবার আগে নিজেকে সচেতন হবে এবং বিলম্ব না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
স্তন ক্যান্সার বর্তমান ভয়াল আকার ধারণ করছে। কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, যেমন- জেনেটিক কারণ। কিন্তু ডায়েট ও লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে এই বিধ্বংসী রোগটির ঝুঁকি কমানো যায়। স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায় এমন কিছু পন্থা হলো- ক্যান্সার প্রতিরোধী খাবার খেতে হবে, অনেক বেশি আঁশযুক্ত খাবার ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমাতে পারে। এর ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% পর্যন্ত কমে। মটরশুঁটি, তাজা ফল, আস্ত শস্য এবং ফ্ল্যাভনয়েড, ক্রুসিফেরাস ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট(ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি) ও ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ সবজি খেতে হবে। পেঁয়াজ, রসুন, পেঁয়াজ পাতা ইত্যাদি সবজিগুলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রিরডিকেলকে নিরপেক্ষ করে এবং ক্যান্সার কোষের বিভক্ত হওয়া প্রতিরোধ করে। এইধরনের সবজি কাঁচা খেলেই সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। সয়াবিন ও অন্য সয়া পণ্য যেমন- টফু ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। কিন্তু মিষ্টি স্বাদের ও রিফাইন্ড সয়া পণ্য যেমন- সয়া দুধ ও সয়া তেল এড়িয়ে চলতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সব নারী দৈনিক ৩০-৪৫ মিনিট ব্যায়াম করেন তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি যারা ব্যায়াম করেনা তাদের চেয়ে কম। তাই ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে ।
বর্তমানে স্তন ক্যান্সার নিয়ে আমাদের দেশে যত বেশি আলোচনা করা হয় এর চেয়ে বেশি আলোচনা করা হয় পাশ্চাত্যে কারণ আগে মনে করা করা হতো এটি ওয়েস্টার্ন ডিজিস কিন্তু কয়েক দশক ধরে এটা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ আগে উন্নত দেশে হলেও এখন উন্নয়নশীল দেশ গুলোতেও যথেষ্ট পরিমাণ দেখা যাচ্ছে। উন্নত দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে স্তন ক্যান্সারের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও উন্নত দেশের মত সচেতনতা বাড়ছে না ফলে আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রে যেমন সহজে নির্ণয় করা যায় না কিন্তু ব্রেস্ট ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে একটু সচেতন হলেই সহজেই রোগ নির্ণয় করা যায়। যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ক্যান্সারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং প্রতিবছর অনেক নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সুস্থ থাকা যায়। এ জন্যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট সময় পরপর মেয়েদের উচিত নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করা বর্তমানে ইউটিউবের সাহায্যে ঘরে বসেই স্তন পরীক্ষা করার উপায় শেখা যায় ।
স্তন ক্যান্সার বিশ্বজুড়েই নারীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি সমানভাবে বিবেচ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে ৯৮ শতাংশের বেশি নারী, তবে খুব অল্প সংখ্যক পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান।
আমাদের দেশে না বেড়েছে স্তন ক্যান্সার বিষয়ক সচেতনতা, না তৈরী করা হয়েছে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা। এর সাথে যোগ হয়েছে, পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে শত শত বছর ধরে চলে আসা বিভিন্ন রকমের কুসংস্কার, কু-প্রথা, এবং কু-বিশ্বাস তাই জ্বর, সর্দি-কাশি প্রভৃতি রোগ নিয়ে যেমন আমরা খোলামেলা কথা বলি তেমনি স্তনক্যান্সার নিয়েও আলোচনা করার মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমাদের সামাজে কিছু কুসংস্কার কু-প্রথা, কু-বিশ্বাস রয়েছে সেইগুলা ভাঙতে হবে। আমাদের দেশের নারীর স্তন ক্যান্সারের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর এই ঝুঁকি থেকে মুক্তির প্রধান উপায় হল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মধ্যে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
উম্মে কুলসুম কাইফা মুক্তমত স্তন ক্যান্সার রোধে সচেতন হতে হবে