লাভ কী?
১১ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৫৯
আমি সেই ১৯৮৫ সালে দেশ ছেড়েছি। বিদেশে বসবাস করার পেছনে ভালো-মন্দের দুটো দিকই রয়েছে যেটা দেশেও ছিলো। তবে বিদেশে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাসগুলো গড়ে উঠে একটু বেশি। যেমন ধরুণ বাজারে গেলাম তরকারি কিনবো। একটি বেগুন ওজন ২৫০গ্রাম কখনও দাম ২০ ক্রোনার আবার কখনও ১৫ বা ১০ ক্রোনার। সস্তা হলে কিনি নইলে অন্য তরকারি কিনি। এমন না যে বেগুন কিনতেই হবে বা পিয়াঁজ নেই খাওয়া বন্ধ ইত্যাদি। মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখেছি। এর মূল কারণ হয়তবা ভিন দেশ, বেগুন নেই তো কি হয়েছে আলু বা অন্য কিছু আছে তো, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই ধরণের মনমানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে। তবে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি কিন্তু মাথায় রেখেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে অভ্যস্ত যদিও সেটা আমার বাবার মত কথায় কথায় প্রকাশ হয়না।
আমার বাবা মারা গেছেন ২০০৭ সালে, তার একটি কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বাবা সুইডেনে এলে বলতাম, চলেন একটু রাজবাড়ি থেকে ঘুরে আসি বা সুইডেনের বাইরে যেমন লন্ডন, জার্মানি, অ্যামেরিকায় বেড়াতে যাই? বাবার প্রথম প্রশ্ন বেড়ায় বা ঘুরে লাভ কী? মা এ কথা বাবার মুখে শুনতেই রেগে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলতে শুরু করলেন, “তোর বাবার মুখে সারাজীবন একই কথা লাভ কী, লাভ কী? যদি কখনও বলি আমার বাবা-মার বাড়ি যাবো, চলো আমাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য, সে বলে লাভ কী সেখানে গিয়ে?”
মার কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম বেশ আবেগ এবং মনে কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছেন। আমি মাকে একটু সহজ করার চেষ্টা করতে আলোচনায় মন দিলাম। তো মাকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা মা, বাবা যে সারাক্ষণ জিজ্ঞাসা করেন লাভ কি? তুমি কী কখনও এর উত্তর দিয়েছো?” মা উল্টো আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন যেমন বাপ তেমন ছেলে। যাক বাঁচা গেল যে বাপের উপর যে রাগ ছিল সেটা এখন আমার উপর পড়েছে। তবে ঘটনাটি তদন্ত করা দরকার, কেন বাবা সব কিছুতে লাভ খোঁজেন!
আমি বাবাকে জিঙ্গেস করেছিলাম সেদিন, “বাবা আমেরিকা যেতে বললাম অন্যকিছু না বলে শুধু বললেন লাভ কি? আপনার মেয়ে জলি থাকে সেখানে, তার একটি মেয়ে হয়েছে, তারপর নতুন একটি দেশ কতকিছু দেখার রয়েছে। এতো কিছু দেখা, অনুভব করা, আপনার যেমন ভালো লাগবে তেমনি জলির ভালো লাগবে, মার ভালো লাগবে, আমার ভালো লাগবে যে বাবা-মার সাথে বিশ্ব ভ্রমণ। কী এগুলো কী লাভ না? নাকি আপনি অর্থের দিকটার কথা চিন্তা করছেন?” বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন তার বাল্যজীবনে। অনেক কথা যা আগে শুনিনি সেসব ঘটনা তুলে ধরলেন, সে এক ইতিহাস। বাবার সব কিছু শোনা এবং জানা হলো সেদিন। কথা শেষে বাবা বলেছিলেন, “পুরো জীবনটাই বাবা হিসাব নিকাশের যেখানে লাভ-ক্ষতি জড়িত। আমি কথার কথা হিসাবে লাভ কী এটাই ব্যবহার করি এই আরকি।
এত বছর পর কথাটি মনে পড়ে গেল কারণ কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে দেখছি বেগুনীর উপর ঝড় বয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী হয়ত কথার কথা হিসাবে বলেছেন বেগুনের বেগুনী না খেয়ে কুমড়ার বেগুনী খেলেই তো হয়। মূলত উনি “বেগুনের দাম বেড়েছে সেটা না খেয়ে কুমড়া ভাঝি খেলেই তো হয় সেটা খেতেও তো মজা।” এটাই মিন করেছেন আমার বিশ্বাস। তবে আজকাল একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটা হচ্ছে সমস্যার সমাধান বাদ দিয়ে অন্য বিষয় নিয়ে টানা হেঁচড়া করা। যেমন: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটা সমস্যা এটা সমাধান না করে প্রধানমন্ত্রীর কথা নিয়ে পুরো গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখা। আমরা বাঙালি জাতি সত্যি একটি পরিবার যার পরিচয় পরিবার থেকে রাষ্ট্রের পরিকাঠামো অবধি লতার মত জড়িয়ে রয়েছে আমাদের সবার হৃদয়ে। কি চমৎকার সব কিছু তাইনা?
তবে বাবার ব্যাখ্যাটি ভালো লেগেছিল যখন বলেছিলেন “বেঁচে থাকার স্বার্থকথা লাভে বাবা। মরার সময় যদি দেখো লাভের চেয়ে ক্ষতির বোঝা ভারি তবে মরেও শান্তি পাবে না, তাই সব সময় লাভ খুঁজি।”
আজ বাবা-মা বেঁচে নেই তবে তাদের স্মৃতি রয়েছে মনে। রোজার মাসে আমার বাবা-মা ডাবের পানি দিয়ে ইফতারি শুরু করতেন গ্রামে, তারপর রোজার সময় বেগুনী না হলে চলে না তাও একটু তৈরি করতেন। বাড়ির কর্তার (বাবা) পেটে সমস্যা, টক দই ছাড়া চলবে না তারও ব্যবস্থা হতো। ছোট বেলার সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গুলো। সেই সাথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি — “ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।”
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি