মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি চপেটাঘাত
১৩ এপ্রিল ২০২২ ২০:২৭
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ, এর মানে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। এটা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। ঠিক তেমনি বাঙালি জাতিরও পহেলা বৈশাখ হলো নববর্ষ। এটাই আমাদের নতুন বছর। কিন্তু আমাদের কাছে আজ এটা কেমন কেমন হয়ে গেছে। কারণ আমাদের কাছে পহেলা জানুয়ারি মানেই নতুন বছর। আমরা অন্যের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছি।
আমাদের সন বাংলা, আমাদের মাস বাংলা কিন্তু আমরা চলি ইংরেজি অনুযায়ী। অনেককেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আজ বাংলা সনের কত তারিখ। সে দেখবেন আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তারিখ-তো দূরের কথা কত সন সেটাই বলতে পারবে না। কিন্তু সবাই আবার বর্ষবরণ করে। এসব আমার কাছে দেখতে একটু অন্যরকম লাগে। আমরা বাংলা সন অনুযায়ি চলি না, বলি না, করি না। অথচ আমরা ‘এসো হে বৈশাখ এসো হে…’ করে গাইতে থাকি। এসব কি লোক দেখানো নয়? কাউকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলা নববর্ষ কখন? সে পহেলা বৈশাখ না বললেও ১৪ এপ্রিল ঠিকই বলবে। কারণ বাংলা মাস, বাংলা তারিখ এসব আমাদের কাছ থেকে এখন অনেকদূরে চলে গেছে। আমরা শুধু এখন লোক দেখানো একদিনের উৎসব করি। প্রকৃত বাঙালি হয়ে উঠতে পারছি না।
বাঙ্গালির জন্য এই দিনটা অনেক আনন্দের, উৎসবের এটা অবশ্যই সঠিক। এই দিনটা বাঙালি জাতির পরিচয় বহন করার একটা দিন। বলা যায় এটা বাঙ্গালির প্রাণ। পহেলা বৈশাখ বাঙালিয়ানার পরিচয়। পহেলা বৈশাখ বাঙালি হওয়ার পূর্বশর্ত। কিন্তু আমরা যেভাবে এগুচ্ছি তাতে একদিন এই দিনটিও অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাংলা র্চচা করি না ঠিকই কিন্তু ইংরেজি শেখার জন্য অনেক অনেক টাকা খরচ করে ফেলি। আমরা ইংরেজি শিখতে শিখতে এমন হয়ে পড়েছি বাংলায় আবার ইংরেজিও মেশাতে শুরু করেছি। আর যারা বাংলার সাথে ইংরেজি মিশ্রণ করে কথা বলে, সমাজে তারাই আধুনিক। সত্যি বলতে এখন সকলেই আধুনিক হতে চায়, প্রকৃত বাঙালি হতে চায় না। এ সমাজও বোধহয় সেটা হতে দেবে না। অথচ, আগেকার সময়ে সকলে বাংলা সনেই চলতো, বাংলা সনেই কাজ করতো। আজও আমার নানু বাড়িতে গেলে নানু জিজ্ঞেস করে, ‘নানাভাই আজকে আষাঢ়ের কত তারিখ?’ আমি তখন অবাক! এখনও বাংলা মাস নিয়ে চলাফেরা করা মানুষ বাংলায় আছে এটা দেখে অনেকটা আনন্দিতও হলাম। নানু বলেন, এক সময় বাংলা সনের তারিখেই বিয়ে, অনুষ্ঠানসহ সব কিছু হতো। কিন্তু আজ আমরা দেখছি তার বিপরীত।
এবার আসা যাক পহেলা বৈশাখ নিয়ে। অনেকেই বলেন আমরা তো নতুন বছরে পদার্পন করেছি। কিন্তু নতুন বছরে তো আমরা এখনও পদার্পন করিনি। সেটাতো ইংরেজি সাল। আমাদের নয়। পহেলা বৈশাখ আমাদের। তাই সারা বছরের সকল জীর্ণতা-ক্লান্তি দূর করে পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে আনন্দ আর ভালোবাসা। পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সাথে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধন। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীন জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালী জাতিকে একত্রিত করে জাতীয়তাবোধে। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশে বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালী এই দিন নিজ সংস্কৃতিতে নিজেকে খুঁজে পায়। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রতিটি বাঙালীর কাছে শিকড়ের মিলন মেলায়। ধর্ম, বর্ণ সকল পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে বাঙালী জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিনত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রংই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালী জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার জন্য এদেশের মানুষ সব সময়ই আন্তরিক, অকৃত্রিম ও অগ্রগামী। দীর্ঘ প্রস্তুতির বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অনেক আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সব পেশার মানুষ। বৈশাখী মেলা হালখাতা অনুষ্ঠান কিংবা নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয় এই নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানাতে। বাংলার পটশিল্পীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। পটশিল্পে জায়গা করে নেয় আমাদের গ্রামীণ জীবনের নানা কথা। লোকজ ব্যবহারিক তৈজসপত্রের বিভিন্ন অংকন শিল্প আমরা খুঁজে পাই এই পটচিত্রের মাধ্যমে। শিল্পী তার রঙ্গীন আল্পনায় স্বপ্ন দেখে আগামীদিনের। নিজ সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠে বাঙালী জাতির প্রজন্ম।
নগরকেন্দ্রিক ব্যস্ততাকে পিছে ফেলে সমস্ত শ্রেনী-পেশার মানুষ এই দিনটিকে সাদরে বরণ করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এই শোভাযাত্রা সকল অপসংস্কৃতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি চপেটাঘাত। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে। বাঙালী সংস্কৃতির জন্য যা ছিল একটি বিশাল অর্জন। এছাড়া রমনার বটমূলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, নৃত্যকলা কিংবা আবৃত্তি। এই শিল্পগুলোর প্রতিটিই স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়কে। বরণ করে নেয় নিজ পরিচয়ের নববর্ষকে।
নববর্ষের এই উৎসব নারী পুরুষ সকলের। উৎসবে যোগ দেয়ার স্বাধীনতাও সবার সমান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নারী হয়রানি এবং নির্যাতনের বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে উদযাপনকালে, উৎসবস্থলে। এবারের নববর্ষের শুভক্ষণে মুছে যাক বিগত বছরের জরা এবং গ্লানি, যার মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন এবং আগুনের ঘটনাগুলো। সকলের প্রতি আহবান, যার যার অবস্থান থেকে, বছরের প্রথম দিনটি থেকেই সকল প্রকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি, আগুনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ি। এছাড়াও সড়ক দূর্ঘটনা থেকে কিভাবে প্রতিকার পেতে পারি সেটাও এবারের পহেলা বৈশাখে আমাদের সকলের ভাবতে হবে। শুধু আনন্দ নয়, দেশের কথাও ভাবতে হবে এবারের পহেলা বৈশাখে।
একটি জাতি যখন তার নিজ সংস্কৃতিতে বলিষ্ট হয় তখন তাকে কোনো অপসংস্কৃতি, কু-সংস্কার গ্রাস করতে পারেনা। তাই নিজ সংস্কৃতির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা শিল্পগুলোর নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। যে কোন জাতির কাছেই তার নিজ সংস্কৃতিই সেরা এবং আপন। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেদের সংস্কৃতির রক্ষায় এবং বিস্তারে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ছায়াতলে অবস্থান নিতে হবে। অন্যান্য সংস্কৃতির সাথেও আমরা পরিচিত হব, তবে তার আড়ালে যেন ঢেকে না যায় আমাদের স্বকীয়তা। কিন্তু বর্তমানে আমরা যেন সে পথেই হাঁটছি। বাঙালি হিসেবে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকাও জরুরী। অন্যথায় পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারী কিংবা বাঙালির যেকোনো উৎসব হবে অর্থহীন। বাঙালির প্রাণ পহেলা বৈশাখকে আরও অর্থবহ করতে হলে প্রয়োজন বাঙালির স্বকিয়তা ধরে রাখা। তবেই বাঙালির প্রাণ বাচঁবে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই
আজহার মাহমুদ মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি চপেটাঘাত