Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল

মো. আশিকুর রহমান সৈকত
২৩ মে ২০২২ ১৯:১৫

তৎকালীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও বিদ্রোহী নটরাজ কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি তার কাব্য সাধনার মাধ্যমে বাংলা কাব্যে নিনাদিত করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী চির যৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবীণার সুর ঝঙ্কার। তিনি বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছেন কালবৈশাখীর ঝড়, প্রমত্ত প্রভঞ্জনের বেসামাল আলোড়ন এবং পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে সঞ্চারিত করেছেন তপ্ত শাণিত ধারা। তাঁর কবিতাগুলো পরাধীন অবিভক্ত ভারতের অবদমিত জনগণের জন্য সঞ্জীবনী মন্ত্র। তাঁর সংগীতগুলো নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারার বেদনার বাণী। চার সন্তানের অকালমৃত্যুর পর জন্ম হওয়ায় নজরুলের নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। বাল্যকালেই পিতা-মাতাকে হারিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন তিনি। এই সময় লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযোজন করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে নজরুল প্রতিভার প্রথম বিকাশ ঘটে।

বিজ্ঞাপন

১৯১৪ সালে নজরুল প্রতিভায় বিমুগ্ধ দারোগা রফিজউল্লাহর মাধ্যমে প্রথম ময়মনসিংহ আসেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায় পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগা নজরুলকে ভর্তি করানোর জন্য তাঁর পাশের বাড়ির ছেলে কাজী ইসমাইলের সাথে ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে পাঠান। নজরুলের না-কি স্কুলটি পছন্দ হয়েছিল কিন্তু জায়গীর না পাওয়ায় ওই স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি নজরুলের। একই সালের জুন মাসে কাজী নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেনকে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে (বর্তমানে নজরুল একাডেমি) ভর্তি করান দারোগা সাহেব।

বিজ্ঞাপন

কাজীর শিমলা গ্রাম থেকে ত্রিশালের দরিরামপুরের দূরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। এই পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হতো নজরুলকে স্কুলে ক্লাস করার জন্য। বর্ষাকালে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। ফলে স্কুলে যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো নজরুলের। এই অসুবিধা লাঘব করার জন্য দারোগা সাহেব ত্রিশালের নামাপাড়ায় তাঁর আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহর বাড়িতে জায়গীর রাখেন নজরুলকে। কিন্তু হামিদুল্লাহ ছিলেন ধার্মিক, পরহেজগার ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক। নজরুল নামাজ পড়তেন না, এজন্য তিনি নজরুলকে ঘৃণা করতেন এবং শাসনে রাখতেন।

বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে পাওয়া যায়, কাজীর শিমলায় নজরুল তিন মাস অবস্থান করেছেন । সেখানে অনেক স্বাধীনতা ছিল নজরুলের । কিন্তু জায়গীর বাড়িতে এতো স্বাধীনতা ছিল না । তাই নজরুল বাঁশি বাজানো, গান গাওয়া, রাস্তাঘাট, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, একটি বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি করতেন । নজরুল তখন তেমন পড়াশোনা করতেন না । তাই নজরুলকে আশ্রয়হীন হতে হয় । পরে তিনি বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে জায়গীর থাকেন । বেপারী বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল । সেই ঘরেই নজরুল থাকতেন । অবশ্য পুকুরটিতে নজরুল গোসল করতেন না । পাশের বাড়ির আরেকটা পরিষ্কার পানির পুকুরে তিনি গোসল করেছেন । কবির স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। প্রথম তলায় অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস রুম এবং তৃতীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়াও কবি যে ঘরে ঘুমাতেন; সেই ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে । পাশেই একটি পুকুর খনন করা হয়েছে ।

নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলের নাম এখন নজরুল একাডেমি । কবি জীবিত থাকা অবস্থায় এবং জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ১৯৬৫ সাল থেকে এ বিদ্যালয় মাঠে জাঁকজমকপূর্ণ নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয় । ১৯৯০ সালে এ স্কুল মাঠে রাষ্ট্রীয়ভাবে জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয় । ২০১৮ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ করা হয় । এছাড়াও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রফিজউল্লাহ দারোগা বাড়ির আঙিনায় নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল পাঠাগার ও স্মৃতি ভবন । সংরক্ষণ করা হয়েছে নজরুল যে খাটে ঘুমাতেন; সেই খাটটিও ।

তবে নজরুলের ত্রিশাল থেকে চলে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না । কেউ কেউ মনে করেন, নজরুল সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম কি দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । ফারসি বিষয়ে আটানব্বই পেয়েছিলেন নজরুল । অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছিলেন ফারসি বিষয়ে । তাই প্রধান শিক্ষক গ্রেস মার্ক দিয়ে পাস করে দিতে বললে নজরুলও গ্রেস মার্ক দাবি করেন । মার্ক না পেয়ে নজরুল বলেন, ‘যে স্কুলে ন্যায় বিচার নেই, সেই স্কুলে নজরুল পড়বে না ।’ এ ঘটনার দু’দিন পরে নজরুল ও আবুল হোসেন ময়মনসিংহে যান । সন্ধ্যা নাগাদ আবুল হোসেন ফিরে এলে নজরুল আর আসেননি । জীবদ্দশায় নজরুলের আর ত্রিশাল তথা ময়মনসিংহে আসা হয় নি । এমনকি ১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে কৃষক-শ্রমিক সমাবেশে প্রধান অতিথি হয়ে আসতে সম্মত হলেও, অসুস্থতার জন্য আসা সম্ভবপর হয়নি। তবে পাঠিয়েছিলেন নিম্নোক্ত পত্রটি, যেখানে ময়মনসিংহের মাটি-মানুষের প্রতি ভালোবাসা গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।

‘ময়মনসিংহ আমার কাছে নতুন নহে । এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী । আমার বাল্যকাল-এ অনেকগুলি দিন ইহার বুকে কাটিয়া গিয়াছে । এখানে থাকিয়া আমি কিছু দিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি । আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে । বড় আশা করিয়াছিলাম আমার সেই শৈশব চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহপ্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব । কিন্তু তাহা হইল না, দূরদৃষ্ট আমার ।

কবি নির্মলেন্দু গুণ যথার্থই বলেছিলেন:

‘ত্রিশালে, কাজীর সিমলায় তুমি আজও
পনেরো বছর বয়সের দুরন্ত কিশোর
হয়ে আছো । আজও সেই প্রথম দিনের মতো,
তোমার পথের পানে চেয়ে থেমে আছে অশান্ত সময় ।
হোক না তা ক্ষণস্থায়ী , তবু তুমি এসেছিলে
এই গর্ব আজও তার প্রধান সঞ্চয় ।’

আর তাইতো কবি গত হওয়ার তিন দশকের মাথায় এই ত্রিশালেই নজরুল নামাপাড়ায় শুকনি বিলের কাছে যে বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজাতেন; সেই বটগাছের পাশেই শুকনি বিলের মাঝে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় । নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপরে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট । জাতীয় কবির বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং জীবনকর্মের ওপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায় পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রাম কোর্স চালু রয়েছে । এ ছাড়াও নজরুল চেতনা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগে বাধ্যতামূলক নজরুল স্টাডিজ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয় । ক্যাম্পাসজুড়েই যেন নজরুলের ছোঁয়া, নজরুলের স্মৃতি । ‘চির উন্নত মম শির’ নামক স্মৃতিসৌধ আর ‘চক্রবাক’ নামক ক্যাফেটেরিয়াই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলের নামও নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নামে । ‘প্রভাতি’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘প্রলয়শিখা’ বাসের নাম আর দুটি মঞ্চের নাম ‘চুরুলিয়া’, ‘গাহি সাম্যের গান’র পাশাপাশি একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নামও নজরুলের বইয়ের নামে ‘ব্যথার দান’ । শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে কবিপরিবারের সদস্যদের নামানুসারে, ‘প্রমিলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’, ‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’ । কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে বইয়ের আলাদা কর্নার । বিশ্ববিদ্যালয়সহ ত্রিশালের অন্যান্য স্থাপনার মাঝেও আজও নজরুল জীবন্ত ।

নজরুল মানবতার কবি । সাহিত্য সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব, বিশ্বপ্রেম, বিশ্বমৈত্রীর আদর্শে সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন । ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানবিকতা, মূল্যবোধ, ভালোবাসাকে যিনি বেঁধেছেন একই সুতোয়, সেই কবি কাজী নজরুলের সাহিত্য অনুপ্রাণিত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে । তাদের হাত ধরেই কবির স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপ ধারণ করবে বাস্তবে । বিদ্রোহী কবি সমাজে যে অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালিয়েছেন, তার আলোকচ্ছটায় দূরীভুত হবে সব অন্ধকার । তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন । তার জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক । নজরুলের অসাম্প্রদায়িক জীবনভাবনা, সাম্যবাদী চেতনা, স্বাধীনচেতা মনোভাব, মানবমুখী জীবনাদর্শ সকলকে উজ্জীবিত করুক এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছি । ‘বাঙলা বাঙালির হোক, বাঙলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক’- কাজী নজরুল ইসলামের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি জানাই অশেষ শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এজেডএস

নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল মো. আশিকুর রহমান সৈকত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর