শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের ঋণ ও অনুদান
২৫ মে ২০২২ ১৩:৫৫
শিক্ষার শুরু হোক দায়ভার নিয়ে। দায়ভার কী? দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করাকে দায়ভার বলা যেতে পারে। জ্ঞানের আরেক নাম সচেতনতা। সচেতনতা অর্জন করতে বর্জন করতে হবে অসচেতনাকে। অসচেতনাকে বর্জন করতে হলে প্রশিক্ষণের শুরুতে কিছু ‘norms and values’ থাকতে হবে।
দেশে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে বহুকাল ধরেই। এখন দরকার প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষার ধরণ পাল্টানো যাতে দেশে ভালো, সৃজনশীল এবং সুশিক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। কারণ শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা বিক্রি করতে না পারলে হতাশা গুদামজাত হবে। পরে এই শিক্ষাই অকেজো হয়ে সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করবে।
পাশ্চাত্যে শিশুর জন্মের শুরুতে তাদেরকে পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দর পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে সুশিক্ষার ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে একটি মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এই ভাতার কিছু অংশ অনুদান হিসেবে এবং বাকি অংশ ধার হিসেবে দেওয়া হয় খুব কম সুদে। শিক্ষাজীবন শেষে যখন তারা কর্মজীবন শুরু করে তখন ধারের অংশ আস্তে আস্তে পরিশোধ করে থাকে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা মডেলকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রশিক্ষণের কিছুটা রদবদল করতে পারলে দেশের শিক্ষার মান বাড়বে বই কমবে না। সে ক্ষেত্রে যেমন যারা অষ্টম শ্রেণী শেষ করেছে, পড়ার প্রতি আগ্রহ কম বা কর্মে জড়িত হতে চায়, তাদেরকে সেভাবে সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে যেমন কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ‘on the job training’।
শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ধরন তৈরি করে নাগরিকের হাতে দেশের দায়ভার তুলে দেওয়া হতে পারে সাফল্যের এক চমৎকার পরিকল্পনা। শিক্ষার্থীদের সাফল্য মানেই দেশের সাফল্য। একটি সচেতন জাতির নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতি এভাবেই হয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের সরকার ধার দেয়, যার ফলে এরা মা-বাবার ঘাড়ে চেপে বসে থাকে না। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে।
কর্মের শুরুতেই তারা সরকার থেকে যে ধার নিয়েছিল, তা মাসে মাসে ফেরত দিতে শুরু করে। এ ধার শোধ দেওয়ার সময়সীমা কর্মজীবনের ব্যাপ্তি, অর্থাৎ ৬৫ বছর অবধি। ৬৫ বছর কর্মের পর এরা অবসর জীবনে চলে যায় এবং সিনিয়র নাগরিক হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণের মতো সুযোগ-সুবিধা যদি বাংলাদেশে চালু করা যায়, তবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের শুরুতেই খুঁজে পাবে এর গুরুত্ব। যেসব শিক্ষার্থী ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, তাদের পেছনে সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকেই পরে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছর যে পরিমাণ অর্থ সরকার বিনিয়োগ করছে, সেটা ধার হিসেবে দিলে পরে সে অর্থ নতুন শিক্ষার্থীর পেছনে বিনিয়োগ করা সরকারের জন্য সহজ হবে এবং দেশে সীমিত ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার থেকে বেশি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করারও সুযোগ বাড়বে।
এ বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে, মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারছে না সীমাবদ্ধতার কারণে। হয়তো কথা উড়বে, দেশভরা ভূরি ভূরি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলে পরে চাকরি পাবে না; তখন বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকবে। না থাকবে না, যদি আমাদের কূটনীতিকরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই এসব ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির সুন্দর ব্যবস্থা করা সম্ভব। কূটনৈতিক এবং দূতাবাসের কাজকর্মের ওপর বা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং তাদের দায়িত্বে থাকা দূতাবাসগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাজেট, সে অনুযায়ী রিটার্ন কি তাঁরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে দিচ্ছেন?
বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের যে পরিস্থিতি, তাতে আনাড়ি ছেলেদের ফুটবল খেলার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। মাঠের যেখানে ফুটবল যায়, সেখানে সবাই জট পাকায়। কখনও কখনও গোলরক্ষকরাও নিজ জায়গা ছেড়ে দিয়ে ফুটবলের পেছনে সারা মাঠ চষে বেড়ায়। সবার লক্ষ্য ফুটবলে লাথি মারা। কার লাথি খেয়ে বল কোন গোলে ঢোকে, সেদিকে কারও খেয়াল থাকে না। আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার অবস্থা দাঁড়িয়েছে আনাড়ি খেলোয়াড়দের ফুটবল খেলার মতো। যখন যে ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনার পেছনে গোটা জাতি ছুটছে। ফলে কোনো সমস্যার সমাধান মিলছে না। অসংখ্য সমস্যার বাঁধছে জট। পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। দেশের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা উন্নয়নে কড়া নজর দিতে হবে। আনাড়ি খেলোয়াড়দের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়া দরকার।
সব শিক্ষার্থীকে স্টাডি লোন দেওয়া এবং জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করা হোক সরকারের নতুন উদ্যোগ। শুধু বর্তমানে কেমন চলছে, তা দেখলে হবে না। আগামী ১০ বছর পর কেমন চলবে, সে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আজকের দিনটা আগামীকাল হয়ে যাবে গতকাল, এ কথা মনে রেখে দেশের শিক্ষা প্রশিক্ষণ পরিকাঠামোর ওপর কাজ করা দরকার। সৃজনশীল শিক্ষা পেতে এবং প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা আশু প্রয়োজন।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত রহমান মৃধা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের ঋণ ও অনুদান