পর্যটনের নতুন দিগন্ত হাওর
২৬ জুন ২০২২ ২২:৫৬
শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও- এই হলো হাওরের প্রবচন। হাওরে শুকনা মৌসুমে কার্তিকের শেষ থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর সবুজ। নিম্নাঞ্চল সবুজ ফসলের হাসি আর টান জায়গায় মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজ ঘাস আর ঘাস। নিম্নাঞ্চলের কোথাও কোথাও বিল, ডোবা, ছোট নালা খাল আর আকাঁ-বাঁকা নদী তো আছেই। বিল বা জলমগ্ন এলাকা হলো মাছের খনি। জলের ধারে আছে হিজল-করচ গাছগাছালি। পাখিদের কলকাকলিতে প্রাণবন্ত থাকে হিজল-করচের বাগ (বাগান)। শীতে হাওরের জলমগ্ন এলাকাজুড়ে অভায়ারন্যে প্রকৃতির মায়াবিনী রূপে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে হাওরের শীতলতা। আবার এই হাওরেই বৈশাখের শেষ থেকে আশ্বিন-কার্তিকের কিছু সময় পর্যন্ত হাওরজুড়ে পানি আর পানি।
ভরা বর্ষায় জৈষ্ঠ্য থেকে শ্রাবণ পর্যন্ত চারদিকে থৈ থৈ পানির মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে ভাসমান দ্বীপের মতোই লাগে। তখন নৌকা বা ট্রলার ছাড়া পা বাড়াবার সাধ্যটি নেই। সুদূরে সবুজ পাহাড়কে দেখা যায় কোথায় যেন হাওরের পানিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় হাওরের পানি কোথাও ঘোলা কোথাওবা স্বচ্ছনীল শান্ত সুবোধ জলবাহিকা। আবার দামাল বাতাসের আস্কারা পেলেই হাওরের পানি যেন উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে জলকেলির উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠে। এই ঢেউ মানে আফাল কখনো কখনো ভয়ঙ্কর বীভৎস রূপ নিয়ে ধ্বংস খেলায়ও মেতে উঠে। তবে প্রকৃতির খেয়ালে এসব কিছুই যেন বিধাতার সৃষ্টি অপরূপের পৃথক পৃথক দর্শনীয় মোহনীয়তার প্রমাণ দেয়। বর্ষায় হাওরের পানিতে থাকে মাছের মুক্ত অভয়াশ্রম আর জলজ প্রাণীদের মেলা। বর্ষাকালে হাওর এলাকার বাসিন্দাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা কিংবা জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র বাহন নৌকা। জাহাজ আকৃতির মালামাল পরিবহনকারী বড় বড় কার্গো আর ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা তো নিত্যদিনকার চিত্র। হাওরের পানিতে হাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশুরা সারাদিন সাঁতার কাটায় মেতে থাকে। চাঁদনী রাতে জ্যোৎস্নার আলোর সঙ্গে ঢেউয়ের মাতামাতি দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। বর্ষাকালে হাওরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোরম! পৃথিবীতে এমন নজির আর কোথাও আছে বলে জানা নেই- যেখানে একই স্থান দুই রূপের ভিন্নতায় প্রকৃতির অপরূপ মায়াশোভিত চিত্র তুলে ধরে বর্ষায় যার একরূপ, শুকনায় তার আরেক রূপ- অধহা কী অপরূপ!
হাওর- প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন। হাওরের প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ্য। বৈশাখের ফসল তোলার মৌসুমে প্রকৃতির নতুন রূপ আর হাওরাঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকার ব্যস্ততা প্রকৃতিবান্ধব সারল্যতায় ভরপুর। হাওরবাসীদের গোহাল ভরা গরু, গোলাভরা ধান, গরু বা মহিষের বাথান, হাসের খামার, পানি শুকানোর সাথে সাথে নিম্নাঞ্চল মাছের খইন আর পাখিদের কলকাকলি এ যেন সৃজনশীলতার মোহনমায়া। শীতে কুয়াচ্ছন্ন হাওরের অতিথি পাখিদের অবাদ বিচরণ। বর্ষায় হাওরের ছোট ছোট দ্বীপের মতোন বাড়ি-ঘর। শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের মায়াবতী দৃশ্য কিংবা বিকেলের স্নিগ্ধতায় দূরের পাহাড়েরর হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য সবকিছুকে বিধাতা যেন অঢেল অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন। হাওরের ভর পানিতে রাতে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকার কুপি বাতি জ্বল জ্বল আলোতে মৎস্য শিকারিদের বিচরণ দেখার মতোন দৃশ্য বটে। হাওরের পানিতে চাঁদের আলোর মায়াভরা স্মৃতি যে কারো হৃদয় কাড়বে। চাঁদনি রাতে নৌকায় হাওরে বেড়ানো আর ছোট ছোট ঢেউয়ের দোল খাওয়ার স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। আবার শ্রাবণ বাতাসে দমকা হাওয়ায় তর্জে গর্জে উঠা আফাল (ঢেউ) আতঙ্ক সবকিছুই মোহনীয় প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যা স্বচক্ষে না দেখলে আফসোস থেকে যাবে বাঙালির। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান। হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সংগীতভান্ডার। প্রাচীন আখড়া, মন্দির-মসজিদের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে হাওরের সুপ্রাচীন ও গৌরবময় অতীতে স্মৃতিচিহ্ন। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে। এই হাওরে রয়েছে প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভান্ডার। হাওরাঞ্চলের হিজল-তমাল বন আকৃষ্ট করে সৌন্দর্য পিপাসুদের। হাওরের সৌন্দর্যে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকরা বিমোহিত হয়েছেন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়ে হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়।
শীত-বর্ষার হাওরের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় হাওরের মাঠে-ঘাটে-বাঁকে। হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে প্রতিদিন ভিড় করেন ভ্রমণ পিপাসু দর্শনার্থী এবং পর্যটক। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জ জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশাল এই হাওর বাংলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশি বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে। হাওর পর্যটন বিকাশে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্বেও এ হাওরে সরকারী ও বেসরকারিভাবে যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে পর্যটন বিকাশে কোন ধরনের অগ্রগতি হয়নি। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা গেলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের এ হাওরগুলো দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। যা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি হাওরবাসীর জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি, হাওরের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। হাওর ট্যুরিজমকে জনপ্রিয়করণে ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশনা দরকার। অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব এবং ওয়েব সাইট ভুমিকা রাখবে। ট্যুর অপারেটরদের সাথে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে না উঠায় হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পড়তে হয় নানামুখী বিড়ম্বনায়। হাওরের পর্যটন খাতকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে দুই ঋতুতেই (বৃহদার্থে) বিরাট অর্থকরী ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে হাওরাঞ্চল। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেতুঁলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জ এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে। একটি ’হাওর বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা যেতে পারে। হাওর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা খুবই জরুরি। হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ, নিয়মিত সংস্কার করা। ডুবোসড়কসহ হাওরের অমসৃণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগি মোটর সাইকেলের মতো তিন চাকার বিশেষ বাইক তৈরি করা যাতে চালকসহ তিন/চার জন যাত্রী বহন করা যায়। নিরাপদ যানবাহন হলে শুকনো মৌসুমে পর্যটকরা স্বাছন্দে যাওয়া আসা করতে পারবে। আশার খবর হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ দিনদিনই বাড়ছে। জাফলং-মাধবকুন্ড ছাড়াও দেশের বৃহৎ দুই হাওর টাঙ্গুয়া ও হাকালুকি, দেশের একমাত্র রাতারগুল, বিছনাকান্দি, পাংতুমাই, ভোলাগঞ্জ, লালাখাল, লোভাছড়া, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি ও রেমা কালেঙ্গা উদ্যান এবং বিভিন্ন চা বাগান দখতে এখন সবসময় ভিড় করেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। এসব থেকে বুঝা যায়- হাওরে পর্যটনের এ বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে ওঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। এই ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলে হাওরাঞ্চলের পর্যটন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। পর্যটন খাতে অনেক আয় হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আর এর জন্য বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনই উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালালে কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকতের মতো হাওর এলাকাও একদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে এমন শুভ প্রত্যাশা নেহাত স্বপ্ন নয় বাস্তবতার উৎসমুখ।
লেখক: উন্নয়ন গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস