শুধু বেঁচে নয়, আজীবন বেঁচে থাকার মন মানসিকতা গড়তে হবে
১২ আগস্ট ২০২২ ১৫:১৭
সেই যে কবে পৃথিবী সৃষ্টির পর মানব জাতির সৃষ্টি হলো তার সঠিক দিন কাল আমরা জানতে পারিনি। জানার দরকার আছে কি? জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (দূরের জিনিসের ছবি তোলার যন্ত্র) গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর মহাকাশে পাঠানো হয়। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরত্বে এই টেলিস্কোপটি অবস্থান নেয়। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা মিলে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এটি নির্মাণ করেছে।
আগামীতে এই টেলিস্কোপ আমাদের জন্য খুঁজে আনবে অজানা ইতিহাস। এই টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র আকাশে অনেক কিছুই পর্যবেক্ষণ করবে। তবে এর প্রধান দুটি লক্ষ্য রয়েছে। একটি হল মহাকাশে ১৩৫০ কোটি বছর আগে একেবারে প্রথম জন্ম নেয়া তারাগুলোর আলোর বিচ্ছুরণ কীভাবে ঘটেছিল তার ছবি নেয়া; এবং দ্বিতীয়টি হল দূরের গ্রহগুলো মানুষের বাসযোগ্য কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা। এখন এর চেয়েও বড় সুখবর হলো, বিজ্ঞানীরা ওয়েব টেলিস্কোপের তথ্যের গুণগত মান বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছেন যে, এই ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে এই টেলিস্কোপ তার থেকেও অনেক গভীরে গিয়ে মহাজগতের চিত্র তুলে আনতে সক্ষম হবে। এর ফলে, অতি শক্তিশালী এই দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মহাশূন্যের অনেক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। ”আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল। আর এই ছবিতে আপনি ছোট ছোট যে আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলো ভ্রমণ করেছে ১৩০০ কোটি বছর,” বলছেন নাসার গবেষক। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মাত্র সাড়ে ১২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্বের গভীর থেকে এই ছবি তুলে এনেছে।
জেমস টেলিস্কোপ এর ছবি থেকে আমরা যে জ্ঞান পেলাম, সেখান থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেওয়ার মতো কিছু আছে? অবশ্যই আছে!
মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির মধ্যে একটি গ্যালাক্সি হচ্ছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। আমাদের গ্যালাক্সির বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে সূর্য। সূর্যের আটটি গ্রহের মধ্যে একটি হচ্ছে পৃথিবী। পৃথিবীর প্রায় ৮৭ লক্ষ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে একটি হচ্ছে মানুষ! পৃথিবীতে আমরা মানুষ জাতি সেরা জীব বলে দাবি করলেও, গোটা মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা অতি ক্ষুদ্র!
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণা করে আমরা মহাকাশের হাজারো অজানা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবো, সভ্যতার অগ্রগতিতে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে।
যাই হোক আমাদের এখন নিজ নিজ জ্ঞানে সামনের দিকে এগোতে হবে এবং তার জন্য দরকার দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ানো। পরবর্তী প্রজন্মকে আমার কাছে একটু বিজ্ঞানবিমুখ বলে মনে হয়। আরও দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে- জ্ঞান বিজ্ঞানে যেখানে পুরো বিশ্ব সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা পরিকল্পিতভাবে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষককে হেনস্থা করছি! এসব আমাদের জন্য একদমই ভালো ফল বয়ে আনবে না। এখনই সময় সচেতন হওয়ার। নইলে দুনিয়ার সব শিক্ষিত সচেতন মানুষরা সামনে এগিয়ে যাবে, আর আমরা পরে থাকবো শত শত বছর পেছনে।
দেশে বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ে নতুন নতুন ইন্সটিটিউট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। বিদ্যমান বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফ্যাসিলিটি বাড়ানো দরকার, সেই সাথে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতেও উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের স্টুডেন্টরা যখন নাসাসহ বিভিন্ন বড় বড় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের প্রজেক্টে জড়িত থাকবে, তখন আমরাও গর্ব করে বলতে পারবো যে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে আমাদেরও অবদান আছে। সাত সকালে এমন করে ভাবছি কারণ সুইডেনে অনেকেই এমন করে শুধু ভাবছে না, রীতিমত কাজ করে চলছে এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পৃথিবীতে তাদের অবদান জন্মে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রেখে তো যাচ্ছেই সাথে আজীবন যাতে সেটা চলমান থাকে তার সু-ব্যবস্থাও করে গেছে, করে যাচ্ছে। আমি যে দুইজন মহামানবের কথা ভাবছি তারা হলেন আলফ্রেড নোবেল এবং ইঙ্গভার কামপ্রাদ। একজন ছিলেন বিজ্ঞানমুখি অন্যজন ছিলেন একজন বুদ্ধিমান উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক, বিশাল ফার্নিচার সাম্রাজ্যের (IKEA) প্রতিষ্ঠাতা এবং ধনীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কার্মুডজিয়ন।
অন্যদিকে আলফ্রেড নোবেল সেই ডিনামাইট আবিষ্কার করে বিশ্বের মানুষকে নানাভাবে উন্নতির শীর্ষে উপনীত করতে সাহায্য করেন। তিনি তার সম্পদের বড় একটি অর্থ ডোনেট করেছিলন এবং তা ছিল ৩৩ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। সেই শত বছর আগে বিশ্ব উন্নয়নে এবং মানব কল্যাণে যা ছিল তখনকার সময়ের মোটা অঙ্কের অর্থ। ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কারের আর্থিক মূল্য ছিল ১৫০৮০০ সুইডিশ ক্রোনার। বর্তমান পুরষ্কারের আর্থিক মূল্য ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। ইঙ্গভারও ডোনেট করেছেন তার সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক যার মূল্য এসময়ে ৬৭০মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। পার্থক্য শুধু আলফ্রেড গোটা বিশ্বের মানুষকে সুযোগ করে দিয়েছেন তার অর্থ পেতে, অন্যদিকে ইঙ্গভার শুধু সুইডেনের নর্থে যারা বসবাস করছে এবং যারা শিল্পকারখানার উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবক শুধু তাদের জন্যে তার এই বিশাল সম্পদ দিয়ে গেছেন। তবে ইতিমধ্যে সুইডেনের নর্থে যে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেখানে শিল্পকারখানার গবেষণা প্রকল্পে ১০০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবী যতদিন থাকবে আলফ্রেড এবং ইঙ্গভার মানবের মাঝে বেছে থাকবেন তাদের কৃতিত্বের অবদানের কারণে। এভাবেই শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো আজীবন মানুষের মাঝে অমর হয়ে বেচেঁ থাকবেন।
আমার ভাবনায় ঢুকেছে আমরা কীভাবে আজীবন স্মরণীয় হয়ে বেঁচে থাকব? কি থাকবে আমাদের অবদান? বড় কিছু না হোক বা বড় কিছু না করতে পারি, সীমিত কিছু ভালো কাজ অগত্যা করে যেতে চাই এমন মানসিকতা যেন তৈরি হয় আমাদের মাঝে।
আমাদের একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না সেটা হলো একটি দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তাদের নৈতিকতা। আমরা তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছি একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে, তৈরি করেছি মহান আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
১৯৭১ সালের সেই রক্তাক্ত আত্মবিসর্জন আমাদের দিয়েছে ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র।
এ মহান আত্মত্যাগ, এই ভৌগোলিক স্বাধীনতা যথার্থ পূর্ণতা পাবে যদি আমরা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে সুস্থ–সবল জাতি গঠন করতে সক্ষম হই। কারণ, একটি সুস্থ–সবল জাতিই পারে সব শৃঙ্খল, প্রতিকূলতা ছিন্নভিন্ন করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।
এখন প্রশ্ন—কীভাবে সম্ভব আমাদের সেই আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা? আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং আচরণের ওপরে নানা ধরনের মানসিক শক্তি প্রভাব ফেলে। তার মধ্যে সুপার ইগো হচ্ছে নৈতিক আদর্শ বা সামাজিক উপাদানের একটি বিশেষ দিক। আমাদের মধ্যে সুপার ইগো বেশি করে ক্রিয়াশীল করতে হবে।
উচিত হবে নৈতিক আদর্শের ভিত্তিকে মজবুত করার কাজে মনোনিবেশ করা। আইনের কঠিন ও কঠোর প্রয়োগ হয়তো ইগোকে শক্তিশালী করবে কিন্তু টেকসই সমাধান হলো সুপার ইগো গঠনে মনোনিবেশ করা। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে এমন সমাজ গঠনের প্রতি যে সমাজে সুযোগ সবার জন্য সমভাবে বণ্টিত। কেননা এর অসম বণ্টন সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে। দরকার সুস্থ প্রতিযোগিতার, দরকার অনুসরণ এবং অনুকরণের। আলফ্রেড বা ইঙ্গভারের মত পৃথিবীতে কিন্তু অনেকেই রয়েছে যাদেরকে আমরা অনুকরণ করতে পারি। পৃথিবী না হোক অন্তত পরিবারের মধ্যে অমর হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পারি যেন মরে গেলে কেউ না বলে ঝামেলা গেছে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস