পুলিশ কি আঙ্গুল চুষবে?
২০ আগস্ট ২০২২ ১৮:৩০
জাতীয় শোক দিবসে বরগুণায় ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে পুলিশের অ্যাকশন নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পেটাচ্ছে। পুলিশ যেভাবে ফ্রি হ্যান্ড লাঠি চালিয়েছে, তাতে অনেকে বাংলাদেশ টি-২০ ক্রিকেট দলে ওপেনারের সঙ্কট মেটাতে পুলিশ বাহিনীর দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও এমন ফ্রি হ্যান্ড পেটাতে পারেন না। তবে পুলিশী অ্যাকশনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া এবং অনেকের বিস্ময় দেখে আমি উল্টো বিস্মিত হয়েছি। অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের পুলিশ বুঝি এই প্রথম এমন বেধড়ক পিটুনি দিল। আমার খালি একটা প্রশ্ন, পুলিশ যদি ছাত্রলীগকে না পিটেয়ে ছাত্রদল বা অন্য কোনো বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে পেটাতো, তাহলেও কি আমরা একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতাম, নাকি তখন চোখ বন্ধ করে রাখতাম, এত বছর ধরে যেমনটি রেখেছি?
প্রথম কথা হলো, পুলিশ কী মানুষকে এভাবে পেটাতে পারে? পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা আইনের লোক। তাদের হাতে লাঠি আছে, বন্দুক আছে, টিয়ারগ্যাস আছে। প্রয়োজনে তারা সেগুলো ব্যবহারও করবেন। কিন্তু সবই করতে হবে আইনের আওতায়। আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার সাধারণ মানুষের যেমন নেই, পুলিশেরও নেই। বরং পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে বলে, তারা আইন প্রয়োগরে ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হবেন, মানবিক হবেন; এমনটাই সবার প্রত্যাশা। তবে আমাদের দেশে বারবার পুলিশ বাড়াবাড়ি করে, আইন লঙ্ঘণ করে। আইনের সাধারণ ধারণায় যা বুঝি, পুলিশ কেন কারো গায়ে হাত তোলার অধিকার কারো নেই। আইন বলে, কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে, অপরাধ করে; পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে, তার বিরুদ্ধে মামলা করবে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করবে, প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি নিয়ে তাকে রিমান্ডে নেবে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত হবে, বিচার হবে, আদালত তাকে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় সাজা দেবেন। সেটা হতে পারে কারাদন্ড, সশ্রম কারাদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, এমনকি মৃত্যুদন্ডও। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার কোনো ধাপেই কারো গায়ে হাত তোলার কোনো সুযোগ নেই, সে যত বগ অপরাধীই হোক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশে হয় উল্টোটা। পুলিশের যেন মানুষকে পেটানোর অধিকার আছে। পেটানো শুরু হয় রাস্তা থেকে। থানায় নিয়ে একদফা পেটানো হয়। আর রিমান্ড মানেই যেন আদালতের অনুমতি নিয়ে পেটানোর লাইসেন্স। অথচ আদালত রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দেয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, পেটানোর জন্য নয়। কিন্তু পুলিশের যেন পেটানো ছাড়া তথ্য আদায়ের আর কোনো কৌশল জানা নেই। এমনও হয়েছে, পুলিশের নির্যাতনে অপরাধ না করেও অপরাধ স্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। এমনকি পুলিশের কাছে খুনের কথা স্বীকার করার পর কথিত খুন হওয়ার ব্যক্তির ফিরে আসার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযুক্তরা তাৎক্ষণিকভাবে নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য অপরাধ স্বীকার করলেও পরে আদালতে গিয়ে তা অস্বীকার করার ঘটনাও কম নয়। আর প্রতিদিন রাস্তায় রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালানসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা পুলিশের যে চড়-থাপ্পর খায়, তা তো আমরা কখনো আমলেই নেই না। অথচ প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার আছে, মর্যাদা আছে।
বরগুনায় জাতীয় শোক দিবসে পুলিশ যা করেছে, এটাই কিন্তু তাদের স্বাভাবিক আচরণ। বছরের পর বছর তারা একই কাজ করে আসছে। এবার খালি ক্ষসতাসীনদের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পিটিয়ে তারা বিপাকে পড়েছে। আলোচিত এএসপিকে দুই দফায় বদলি করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে আরো অনেককেই। যেন ছাত্রলীগ পেটানোটাই অপরাধ। গত ৩১ জুলাই ভোলায় পুলিশের গুলিতে বিএনপির দুই নেতাকর্মী মারা গেছেন। সে তুলনায় বরগুনায় তো শুধু পেটানো হয়েছে, গুলি করা হয়নি। বরগুনায় একই ঘটনা যদি বিএনপি বা অন্য কোনো দলের সাথে হতো, তাহলেই আর এত আলোচনা, এত বদলি, প্রত্যাহার, ক্লোজ কিছুই হতো না। সমস্যা হলো, আপনি যদি কাউকে অন্যায় করার অনুমতি দেন, তাহলে সেই লাইসেন্স দিয়ে অনেকগুলো অন্যায় করে ফেলবে। আপনি আর তাকে কিছু বলতে পারবেন না। সামরিক শাসন বাদ দেন, আগের সব আমল বাদ দেন। বর্তমান সরকারের গত ১৩ বছরে পুলিশ পেটাতে পেটাতে রাজনীতিকে রাজপথ থেকে প্রেসক্লাবের হলরুমে তুলে দিয়েছে। এই সময়ে বিএনপি তো বটেই, নিরীহ বামেরাও পুলিশের পিটুনি থেকে রেহাই পায়নি। তখন যদি সরকার ব্যবস্থা নিতো, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সায় না দিতো; তাহলে আজ জাতীয় শোক দিবসে ছাত্রলীগ নেতাদের পিটুনি খেতে হতো না। আপনি যখন বোতল থেকে দৈত্যকে বের করে ফেলবেন, তাকে আবার বোতলে বন্দি করা সহজ নয়। আগে তো ছিলই, ২০১৮ সালের পর পুলিশের দাপট আরো বেড়েছে। পুলিশ মনে করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে তাদের অবদান বেশি। তাই তারা এখন আর কাউকে পরোয়া করে না। একজন সংসদ সদস্যরে সাথে পুলিশের একজন এএসপি যে ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন তা কোনো প্রটোকলেই পড়ে না। এই সাহস পুলিশ পেয়েছে সরকারের কাছ থেকেই। এর আগেই বিরোধী দলীয় এক সংসদ সদস্যকে রাজপথে দৌড়ে দৌড়ে পেটানোর দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি। তখন কিন্তু কারো বদলি হয়নি, বরং প্রমোশন হয়েছে। এভাবেই দিনের পর দিন পেটাতে পেটাতে পুলিশের সাহস বেড়েছে।
ভোলায় পুলিশের গুলিতে দুই জনের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ভোলার ঘটনা কে ঘটিয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখুন। কীভাবে ঘটেছে, কারা আক্রমণ করেছে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারা মিছিল করেছে, কারা সেই অস্ত্র দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ কি করবে? আঙ্গুল চুষবে? পুলিশের এএসপি মহরম আলী যখন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর মুখের ওপর আঙ্গুল তুলে কথা বলছিলেন, তখন আমার খালি ওবায়দুল কাদেরের প্রতিক্রিয়াটির কথা মনের পড়ছিল। মহরম আলীল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সংসদ সদস্যকে সে কথাটিই ফিরিয়ে দিচ্ছেন, পুলিশের গাড়ি ভাঙলে পুলিশ কি আঙ্গুল চুষবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি