Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চা শ্রমিকদের আর্তনাদ কবে বন্ধ হবে

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
২২ আগস্ট ২০২২ ১৮:০১

রোগে আক্রান্ত হলে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তিনবেলা পেট ভরে যে খাবার খাবে, তাদের ঘরে কোনো খাবার নেই। ঘরের চালা ফুটো হয়ে পানি পড়ে। শরৎতের আগমনীতে তীব্র গরমে ঘরে বসেই সাদা মেঘের ভেলা দেখা যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করা তো দূরের কথা প্রকৃতির সৌন্দর্য্য তাদের কাছে যেন এক বড় অভিশাপ! পেটের ক্ষুধার জ্বালায় নিয়ে তাদের দিন গুনতে হয়। ফলে তাদের জীবনের সুখ উল্লাস বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে তাদের মনে আনন্দ আসে তখনি যখন বছরে দু-একটি কোনো উৎসব আসে তখন তারা মাছ মাংস খেতে পারে। তা বাদে আর কোনো দিন মাছ মাংস খাওয়া তাদের ভাগ্যে হয় না। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই কারণ তাদের কাছে কোনো টাকা নেই। আর টাকা নেই বলেই তাদের সন্তাদের স্কুলে পড়াতে পারে না। আবার কেউ পড়াতে চাইলেও এনজিওর কাছে লোন নিয়ে পড়াতে হয় আর লেখাপড়া থামিয়ে যায় টাকার অভাবে। কতটা মানবেতর জীবন যাপন করে তারা? তাদের জীবনের দুর্দশার কথা কি শেষ আছে?

এমন জীবন ব্যবস্থা দেখে আপনারা হয়তো বা ভাববেন দাস সমাজের বৈশিষ্ট্য কিংবা গল্প বলতেছি। তাহলে ভূল বুঝবেন কারণ কথা গুলো বলতেছি ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির’ দেশের কথা। সেই দেশ আপনার আমার দেশ। সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত শোষণ মুক্ত স্বাধীন দেশে বৈষম্য চলছে। সেই বৈষম্যের কথা বলতে হচ্ছে ও বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সিলেট অঞ্চল। সেই অঞ্চলকে বলা হয় ‘দুটি পাতার একটি কুঁড়ির’ দেশ। কারণ ওই অঞ্চলের মানুষের চায়ের সঙ্গে এভাবেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।

চায়ের সুবাদে সিলেটের সুনাম ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। বর্ষার মৌসুমের শুরু থেকে শীত মৌসুমের আগ পর্যন্ত সিলেটের চাবাগানগুলোয় চলে চা-পাতা তোলা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পালা করে চা-পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন নারী-পুরুষ চা-শ্রমিকেরা। পাতা তোলা শেষে তা লাইন ধরে জমা দেন শ্রমিকেরা। ওজন শেষে চা-পাতা স্তূপ করে রাখা হয় চা তৈরির জন্য। যাদের শ্রমের ঘামে বিশ্বব্যাপী সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে আজ তারা কেমন আছে? তাদের জীবনযাপন কেমন করে চলে রাষ্ট্র কি কখনো দেখার চেষ্টা করেছেন? খুব উদ্বিগ্নতার সাথে বলতে হয় চা শ্রমিকদের জীবন ব্যবস্থা দাস যুগকেও হার মানিয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে নাগরিক এমন মানবেতর জীবনযাপন করতে পারে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ২৪১টি চা বাগানে এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে। দেড় লাখের বেশি শ্রমিক চা পাতা তোলার কাজ থেকে বিরত আছেন। ইতোমধ্যে বুঝতে পারছেন কেন তারা ধর্মঘট শুরু করেছেন। আমাদের দেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সব মিলে আয়তনে চা বাগানের সংখ্যা ১৫৮টি। আর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১ লাখ ১২ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১৫ হেক্টর জমিজুড়ে চা বাগান আছে। ফলে ওই এসব বাগানে কাজ করেন ১ লাখ ৪০ হাজার ১৮৪ জন শ্রমিক। সরকারি মতে, চা শ্রমিকের মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন এবং অনিবন্ধিত ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন। নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে পুরুষ ৬৯ হাজার ৪১৫ এবং নারী ৭০ হাজার ৭৬৯ অর্থাৎ নারী শ্রমিকের সংখ্যা পুরুষ শ্রমিক থেকে ১ হাজার ৩৫৪ জন।

এসব শ্রমিকরা দিনে কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা তোলেন তার বিনিময়ে তাদের মজুরি দেওয়া হয় ১২০ টাকা। আবার সেই মজুরির মধ্যে আছে ফাঁকফোকর যারা দিনে ২০ কেজির কম পাতা তোলতে পারে তাদের টাকা কেটে নেওয়া হয়। অর্থ্যাৎ প্রতি কেজিতে ছয় টাকা করে কেটে নেয় মালিকরা। চা শ্রমিকদের শ্রম চুরি কথা রাষ্ট্র কি জানেন না? কেন নিরবতা পালন করেন? ফলে রাষ্ট্রের জেগে ঘুমানোর ঘুম ভাঙাতে চা শ্রমিকরা রাজপথে এসে স্লোগন দিচ্ছে, আমরা মাছ মাংস ও ডিম কেন খেতে পারি না? আমার সন্তান কেন স্কুলে পড়তে পারবে না ? ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হবে, রুটি রোজির সংগ্রাম চলবে চলবে ’ খুব কষ্টের সাথে বলতে হয় বর্ত মান দ্রব্যমূল্যেূর ঊর্ধ্বগতি বাজারে দিনে মাত্র ১২০ টাকার মজুরি দিয়ে কি তাদের সংসার চালাতে পারে? চা শ্রমিকদের আর্তনাদ রাষ্ট্রের বুঝা উচিত কারণ বর্তমানে দুই কেজি চাউলের দাম ১২০ টাকা, সয়াবিন তেলের দাম ১৯৫ টাকা, এক হালি ডিমের দাম ৬০ টাকা, পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে, চিকিৎসার ওষুধ পত্রের দামও বেড়েছে অর্থ্যাৎ বাজারে যা কিনতে যাবে সবই ঊর্ধ্বমুখি। সেই হিসাবে মাথায় রেখে চা শ্রমিকদের জীবন চলার জন্য সংসার খরচের হিসাব রাষ্ট্রের করা উচিত। ফলে শ্রমিকরা দাবি তুলেছেন তাদের মজুরি ৩০০ টাকা দিতে হবে। তা খুব যৌক্তিক দাবি । কিন্তু বাস্তবে এই দাবির পিছনে অনেক কথা থেকে যায় কারণ তারা যে দাবি তুলেছেন তা বর্তমান জীবন ব্যবস্থায় তাদের দাবি খুব অপ্রতুল কারণ দিনের ৩০০ টাকা মজুরি দিয়ে তাদের জীবন যাপন করা আদৌও সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ৩০০ টাকা দাবি তুলেছেন? কারণ তারা এতটাই কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা বলা বাহুল্য। ফলে তারা কষ্টের মধ্যে থেকে একটুখানি কষ্ট দূর করার জন্য তাদের সেই দাবি তুলেছেন। যাতে তাদের দাবি দ্রুত মেনে নেওয়া হয়। ফলে চা শ্রমিকরা যাতে নিজেও কোনো ভাবে বাঁচতে পারে আর মালিদের কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু পুঁজিবাদীরা বড় নিষ্ঠুর তারা শুধু খোঁজে মুনফা। শ্রমিকের জীবনের মূল্য তাদের কাছে নেই। ফলে পুঁজিবাদীরা হলেন শ্রমিকের দেহের রক্তচোষা। তারা কখনো শ্রমিকের জীবনমান উন্নত করতে চায় না। তারা শুধু চায় শ্রমিকদের দাস করে রাখতে চায় আর তারা হবেন পুঁজির প্রভু।

নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর পর মজুরি পুনর্নির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকদের যোগসাজশে প্রতিবারই নির্ধারণ প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখে শ্রমিকদের বারবার ঠকানো হয়। এবারও মজুরি নির্ধারণের সময় প্রায় ২০ মাস অতিবাহিত হলেও মজুরি বোর্ডের কোনো পদক্ষেপ নেই বরং চা শ্রমিকদের দাবি গুলো মালিকদের কর্ণপাতে হচ্ছে না। মালিক শ্রেণির এই চরিত্র পাল্টাতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা। আর্তনাদে থাকা চা শ্রমিকদের স্লোগানের ভাষা আমাদের বুঝা উচিত। কেন তারা কাজ ছেড়ে রাজপথে অবস্থান ধর্মঘট করছে? দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশের হাহাকারের শব্দে কেন আকাশ ভারি হচ্ছে তা খুঁজে বের করা দরকার। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ৬টি মৌলিক অধিকার একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজ। এ মৌলিক অধিকার গুলো তো রাষ্ট্রেকেই নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৩ হাজার ৬০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক আয় ৪৩ হাজার ২০০ টাকা। তাহলে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ভালো খবর কিন্তু শ্রমিক আয় কি বেড়েছে? আমাদের দেশে চা-শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে চা-শ্রমিকদের মজুরি ১৬৮ টাকাও হলো না এর চেয়ে বড় হতাশার কথা আর কি হতে পারে!

বিশেষ করে চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানেরা চিকিৎসা সেবা পায় কি না তা খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ সুযোগ আছে কি না তা নজর দিতে হবে। আন্দোরত চা শ্রমিকরাই গণমাধ্যমে কান্নাস্বরে বলছেন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংকট, শ্রেণিকক্ষে জায়গার সংকট, যেখানে শ্রেণিকক্ষ আছে সেখানে আবার শিক্ষক নেই। এভাবে কি তাদের সন্তানেরা লেখাপড়া করতে পারবে ? সে উত্তর আমার কাছে জানা নেই তার উত্তর রাষ্ট্রকে দিতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকী, মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। অপর দিকে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নেশার ঘোরে রাখার চেষ্ঠা করে। যাতে করে শ্রমিকরা নিজের অধিকার নিয়ে যেনো সোচ্চার না হতে পারে কিন্তু কত দিন নেশার ঘোরে থাকবে সময় এসেছে শোষকের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলার। সময় এসেছে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার করার।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

চা শ্রমিকদের আর্তনাদ কবে বন্ধ হবে মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর