Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা পুড়ছি তীব্র দাবদাহে

প্রদীপ সাহা
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:৩৫

কাঠফাটা রোদ আর প্রচন্ড দাবদাহে পুড়ছে প্রকৃতি, জনজীবন হয়ে উঠেছে দুঃসহ। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াটাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু আমাদের দেশই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই আজ তীব্র দাবদাহের শিকার হচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ এখন আর উপভোগ করা যায় না। সকালেই দেখা যায় ভরদুপুরের কঠিন কাঠফাটা রোদ, যেন পুড়ে সব ছাড়খার করে দিচ্ছে। বদলে গেছে চিরায়ত ঋতুর চিত্র, বদলে গেছে প্রকৃতি। কোনো ঋতুর সঙ্গেই যেন আজ প্রকৃতির মিল খুঁজে পাচ্ছি না।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রসীমায় আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে চলতে শুরু করেছে তীব্র তাপদাহ। নজিরবিহীন দাবদাহে পুড়ছে প্রায় অর্ধেক বিশ্ব। দাবদাহের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বর্তমান জলবায়ু সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আজ প্রকৃতির এ কঠিন রূপ আমাদের দেখতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আজ খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, উজানে পানির ঢল এসব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের প্রভাবে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে তাপমাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং উষ্ণতাপ্রবণ এলাকা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বারবার বলছেন, গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস বা বন্ধ না করা হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে এবং এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাবে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে দ্বিগুণ বাড়ছে। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৪ দিন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল বছরে ২৬ দিন।

বিজ্ঞাপন

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বন নিধন, ব্যাপক শিল্পায়নসহ অন্যান্য দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্টকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন ও ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত গ্রিনপিসের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ৩ লাখ ৫০ হাজার বছরে বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণ বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে গত ৩২৫ বছরে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে এবং গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ার ফলে উৎপাদিত হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্প্রে, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার প্রভৃতি যন্ত্র থেকে সিএফসি গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব গ্যাসের প্রভাবে অতিমাত্রায় সূর্যতাপ পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে আটকা পড়ে মারাত্মক গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। গ্রিন হাউজের এ প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ এবং জনজীবন তথা সমগ্র পৃথিবী আজ হুমকির সম্মুখীন।

আমাদের পৃথিবী ডুবে আছে এক বিরাট বায়ুসমুদ্রে। এ বায়ুমণ্ডলের গড় অবস্থা হচ্ছে জলবায়ু। অর্থাৎ বায়ুর গড় তাপ, আর্দ্রতা, প্রবাহ এসব মিলে হলো জলবায়ু। জলবায়ুর প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তাপ। আর পৃথিবীতে এ তাপশক্তির মূল উৎসই হচ্ছে সূর্য। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুর নজিরবিহীন পরিবর্তন ঘটে। আর এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণই হচ্ছে গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। সাধারণ অবস্থায় সূর্য থেকে যে তাপশক্তি আসে, তার কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং বেশিরভাগই প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় বায়ুম-লে চলে যায়। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস জমে আছে, তা ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত তাপ শোষণ করে এবং ভূম-লের তাপ বিকিরণে বাধা দেয়। ফলে পৃথিবীর উপরিভাগ ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে এবং আমরা পুড়ছি তীব্র দাবদাহে। মনে হচ্ছে, প্রকৃতির অভিশাপে আকাশটা অনেকখানি নিচে নেমে এসে আমাদের তাপে পুড়িয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এখানে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরু প্রবণতা দেখা দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিন্মাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। বন্যার ব্যাপকতায় মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, গবাদিপশু, দালানকোঠা ও ভৌত কাঠামোসহ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হবে। যার প্রমাণ বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা। এ বছর (২০২২) সিলেটের ভয়াবহ বন্যাও তার আরেকটি প্রমাণ। উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা এবার আকস্মিকভাবে বন্যাকবলিত হয়। অন্যদিকে, উজানের পানি একতরফাভাবে ভারত আটকে রাখার ফলে প্রমত্ত পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তার মতো নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি সংকটের কারণে যেমন বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যাও দেখা যাচ্ছে।

দ্রুত শিল্পায়ন ও শক্তির ব্যবহার আজ অপরিহার্য। কিন্তু এর ফলে সৃষ্ট জলবায়ুর পরির্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতির কারণে সারা বিশ্ব আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হওয়ার প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হতে পারে। তবু তারা আশাবাদী, যথাযথ ব্যবস্থা ও কর্মসূচি গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে রাখা সম্ভব হতে পারে। আর এই ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের বিদ্যুৎ এবং সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবহারে অপচয় রোধ করতে হবে এবং দক্ষতা বাড়াতে হবে। সৌর ও অন্যান্য শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ধানক্ষেতে সেচের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যাতে মিথেন গ্যাস কম নির্গত হয়। কলকারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গৃহস্থালী ও শিল্প-কারখানার আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। সর্বোপরি অধিক হারে বনায়ন বাড়াতে হবে এবং বন উজাড়ের প্রবণতা রোধ করতে হবে।

সম্প্রতি (১৫ জুলাই ২০২২) যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের একটি মাত্রাচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ওইদিন দুপুরে স্পেনের সেভেলি শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। অন্যদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে (১৬ জুলাই), আমাদের দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বেশিরভাগ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে (১৫ জুলাই), ভারতের বেশিরভাগ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সহজেই বুঝতে পারছি, কী এক কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ আমরা পরিবেশ এবং প্রকৃতির যে ভয়াবহ রূপ পর্যবেক্ষণ করছি, যেভাবে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা- তাতে গভীর এক শঙ্কা সহজেই নাড়া দিচ্ছে বারবার। প্রশ্ন জাগছে- আধুনিকায়নের ফলে আমরা কেন এ সুন্দর পৃথিবীটাকে সহজেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমরা কেন সবাই মিলে সচেতন হতে পারছি না? এখনো সময় আছে- আসুন, এ সুন্দর পৃথিবীটাকে বাঁচাতে এবং টিকিয়ে রাখতে আমরা সবাই সচেতন হই। প্রকৃতির সবুজের পাশে আমরা প্রত্যেকেই তৈরি করি একটি সুন্দর দেশ, সুন্দর পৃথিবী।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আমরা পুড়ছি তীব্র দাবদাহে প্রদীপ সাহা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর