ভোরের আলো
৩১ আগস্ট ২০২২ ১৫:০৩
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বিছানা ছেড়ে কিচেন রুমে গেলাম। সূর্য পূর্ব আকাশ ফর্সা করে ফেলেছে। সুইডেনে গ্রীষ্মের দিন বড় এবং রাত খুবই ছোট যা শীতে হবে পুরোটাই উল্টো। আজ একগাদা ঝামেলা আমার মনের মধ্যে উকিঝুকি মারছে। সাত সকালে মনটা খারাপ হোক এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে চাচ্ছিনা। তাছাড়া মনটা খারাপ হবার পেছনে যে কারণগুলো জড়িত তার একটাও আমার নিয়ন্ত্রণে না। ভাবা এবং মন খারাপ করা ছাড়া কিছুই করার নেই, তারপরও মন থেকে সমস্যাগুলো সরানো যাচ্ছে না। সাত সকালে সূর্য উঠল কিরণ দিয়ে আর আমি উঠলাম একগাদা ঝামেলা মাথায় নিয়ে! নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা ধরণের চেষ্টা করতে শুরু করলাম। যতই চেষ্টা করছি পজেটিভ ভাবে ভাবতে ততোই খারাপ চিন্তাগুলো এসে হাজির হচ্ছে।
খারাপ চিন্তাগুলো যে শুধু নিজেকে নিয়ে তা নয়, যেমন: চলছে প্রকৌশল, মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। সবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এ যেন জীবনের ব্যর্থতা বা সফলতার এক চূড়ান্ত ধাপ। কেউ সফল হয়ে ধরাকে সরা মনে করছে, কেউ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধুকে ধুকে কষ্ট পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যর্থতা ও সফলতা শুধু ভর্তিযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ কিন্তু স্নাতক, স্নাতকোত্তরের অসংখ্য শিক্ষার্থীরও সফলতা ও ব্যর্থতা রয়েছে সেটা কি খেয়াল আছে? তারপর স্বপ্ন দেখা এবং তা পুরন না হবার হতাশা রয়েছে, রয়েছে প্রেমে ব্যর্থ, কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ। কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে কীভাবে সফল হওয়া যায় সেটা ভাববার সময় নেই। আমার ভাবনায় ঢুকেছে যেমন শতকরা কতভাগ মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা আমরা খুব সময় তুলে ধরি বরং কে কবে কিভাবে বিশাল কিছু করল সেটা নিয়ে লিখি, কথা বলি ইত্যাদি। আমরা ব্যর্থতার কারণ খুঁজি যেমন ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়া, দেরিতে শুরু করা, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারা। এসব কারণ ঠিকঠাক মানিয়ে চলতে পারলে ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠে সফল হওয়া সম্ভব। যারা সফল তারা এভাবেই হয়েছে, এসব বলি, কখনও বলিনা যে প্রতিযোগিতায় আমার থেকে অন্যেরা ভালো করেছে, আমাকে আরো খাটতে হবে ইত্যাদি। এমতবস্থায় কী করা যেতে পারে!
হঠাৎ মনে পড়ে গেল বহুবছর আগের একটি ঘটনা।
একবার এক সাক্ষাৎকারে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- ‘ভালো কিছু করার পেছনে একটা মোটিভেশন থাকে। আমার অনুপ্রেরণার উৎস কী?’ জবাবে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম।
আমি একবার আরিচার ঘাটে এক বৃদ্ধের দোতারা বাজানো শুনেছিলাম, মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন কোন মিস্তুরী বানাইয়াছে..। সেদিন আরিচার ঘাটে আমার সঙ্গে ছিলো আমার সঙ্গীনি মারিয়া। মারিয়া আমার স্ত্রী সে খুব মুগ্ধ হয়ে বৃদ্ধকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিল। আমার বৃদ্ধের দোতারাটি পছন্দ হয়েছে, তাকে বললাম, ‘বিক্রি করবেন?’ মুরব্বি বললেন, ‘টাকা লাগবে না আপনার পছন্দ হইছে নিন’। মারিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘মুরব্বি কি বলছে?’ আমি বললাম ঘটনা। মারিয়া আমাকে বলল, ‘না তুমি তার বাদ্যযন্ত্রটা নিবে না বরং তাকে আরো কিছু টাকা দাও যেন সে প্রতিনিয়ত এটা আরো বেশি করে বাজায় এবং তাকে বলো যে তুমি গরীব বলে তোমাকে সাহায্য করছি সেটা ঠিক না। তোমাকে তোমার প্রতিভার কারনে পুরস্কৃত করছি।’ মারিয়ার কথাটি ভালো লেগেছিল সেদিন। আমাদের মনে অনুপ্রেরণা সুলভ চিন্তাভাবনা তৈরি করতে হবে। পজেটিভ হতে হবে। মনে রাখতে হবে অভাব বা সমস্যাকে ভালোবাসলে আর কিছু না হোক স্বভাব ভালো হয়।
আমি সেই থেকে যাই করি মন দিয়ে করি এবং যখনই সমস্যা দেখি ভাবি তাদের কথা যারা আমার থেকে খারাপ অবস্থানে থেকেও মনের আনন্দে অন্যকে বিনোদন দেয়। প্রতিবার সমস্যা এলে আমার মাথায় এসে হাজির হয়- আরিচা ঘাটের সেদিনের সেই কথা। তারপর উন্মুক্ত বিশ্বভাণ্ডারে ঢুকে গেলাম। স্রষ্টার রহস্যের উপর ভাবছি। কি বিশাল কারুকার্য যার শুরু বা শেষ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আমার কল্পনায় আমি যে জার্নি শুরু করলাম তার শেষ দেখা হলো না। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিনা, এটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে! আমার দেহ, আমার প্রাণ, আমার মাঝে বিদ্যমান অথচ নিয়ন্ত্রণের বাইরে! হঠাৎ পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা পড়েছে। সূর্যের খোঁজ নেই, মেঘ ঢেকেছে তাকে। সময় থেমে নেই, ছয়টা বেজে গেছে। ঘুম থেকে উঠেছি যখন তখন সকাল চারটে বাজে। দুই ঘণ্টা হয়ে গেল আমি উঠেছি অথচ তেমন ক্রিয়েটিভ কিছু করতে পারিনি এখনও। শুধু কিছু অসম্পূর্ণ লিখা পূর্ণ করে সংবাদপত্রে ইমেল করছি। এর মাঝে সামাজিক খবরাখবরগুলোর দিকে নজর দিয়েছি, কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। যা ঘটেছে সেই সকাল থেকে তাও লিখছি। যে জগতটি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেটাই আমার মনকে চাপের উপর রেখেছে। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য ঢাকা পড়েছে ঠিক তেমনি আমার মনের উপর একগাদা ঝামেলা এসে সুন্দর ধ্যান এবং জ্ঞানের ভান্ডারকে ঢেকে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে।
এমন একটি সময় যার সান্নিধ্যের বেশি প্রয়োজন তিনি হচ্ছেন পরম করুনাময় দয়ালু আল্লাহ তায়ালা, একমাত্র তিনিই পারেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে। এই সামান্য একটি বিশ্বাস আমাকে হঠাৎ করে মুক্ত করে দিল আমার সমস্ত বাধাবিঘ্ন। এটাই ছিল আজ ভোরের ধ্যানের গুনাগুন। হে রহমানুর রাহিম, তুমি আমাকে, আমাদের সবাইকে ভোরের প্রথম আলোর সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার তৌফিক দান কর, আমিন।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি