একজন জনপ্রতিনিধি ও বঙ্গমাতা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২৮ অক্টোবর ২০২২ ২২:৩৬
শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা ভাবনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সঠিক শিক্ষা ছাড়া দেশ গঠন কখনই সম্ভব নয়। তাই তো তিনি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশে গণমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তাই তো যুদ্ধপরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার পুনসংস্কারের জন্য। উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্য এবং সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নেয়া হয় পরিকল্পনা। সেজন্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত ই খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশনও গঠন করেছিলেন তিনি। আর এলক্ষ্য ছিলো শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় মানোন্নয়ন ও গণমুখী করা।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনাই শেখ হাসিনা সরকারের মূলনীতি ও আদর্শ। এরই আলোকে তৈরি হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী মির্জা আজম তাঁর মেধা, সততা, সদিচ্ছা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দুর্বার গতিতে কাজ করে চলেছেন শিক্ষাবিস্তারে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের ‘শিক্ষাই সব শক্তির মূল’ বক্তব্যের মতো তিনিও মনে করেন, ‘শিক্ষাই শক্তি। উন্নয়নের সোপান শিক্ষা।শিক্ষিত মানুষই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। কেননা আত্মোন্নতি হচ্ছে বড় উন্নতি।’
তাই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে তিনিও শিক্ষাকেই হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যার শুরুটা করেছেন নিজ নির্বাচনী এলাকা মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ দিয়ে। যদিও শিক্ষাউন্নয়নের এই আভা ছড়িয়ে পড়েছে ২০৩১.৯৮ বর্গ কিলোমিটারের জামালপুরে। গত তিন দশকে মাদারগঞ্জ-মেলান্দহে গড়ে তুলেছেন ৬০টির বেশি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। দুইশোর বেশি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ হয়েছে। ফলে এতদ্অঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বলছে ঘরে ঘরে। পুরো জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ছাড়াও শিক্ষা এবং যুবউন্নয়নে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সংস্কার করেছেন। জেলাজুড়ে অবকাঠামোসহ অন্যান্য উন্নয়ন তো রয়েছেই।
শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জামালপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও স্বপ্ন দেখেন তিনি। যেখানে পড়তে আসবে দেশে-বিদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা। নেমে সেই পড়লেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে। এই লক্ষ্য নিয়েই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মেলান্দহের মালঞ্চ এলাকায় ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের একমাত্র কলেজ হিসেবে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেতেন। ধাপে ধাপে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে নিয়ে কলেজটির উন্নয়নে কাজ করেন প্রতিষ্ঠাতা মির্জা আজম, এমপি।
তিনি চেয়েছিলেন, প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের মাঝে উচ্চশিক্ষাকে সহজলভ্য করতে এবং সবুজ প্রকৃতির কাছাকাছি আদর্শ পরিবেশের মধ্যে তরুণ শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিতে। কেননা এতে মানুষ শুধু সনদই অর্জন করবে না, মানবিক গুণও শাণিত হবে। একপর্যায়ে এই কলেজের শিক্ষার্থী ও জনগণও এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হোক- এমন স্বপ্ন দেখতে থাকেন। আর জনমানুষের প্রতিনিধি একজন মির্জা আজম দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়লেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট কার্যালয়/অফিসে যোগাযোগ শুরু করেন। এর মাঝে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। জননেতা মির্জা আজম কিন্তু থেমে নেই, তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জামালপুর সফর করেন। ওই সময় তৎকালীন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজ মাঠে আয়োজিত বিশাল জনসভায় এ অঞ্চলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। ‘বাঙলার যুবকণ্ঠ’ মির্জা আজম এ দাবি তুলে ধরেন মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, সরকার গঠন করলে জামালপুরে একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জননেতা মির্জা আজমও নাছোড়বান্দা, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চাইলেন- তাঁর প্রতিশ্রুত সেই বিশ্ববিদ্যালয়। নানা প্রচেষ্টায় অবশেষে প্রক্রিয়া শুরু হয়। কখনও কাজ চলে দ্রুতগতিতে, কখনও শ্লথ। তবে বসে নেই মির্জা আজম, এমপি। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি যাননি কিংবা কথা বলেননি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়ও শত ব্যস্ততার মাঝে ছুটে গেছেন সংশ্লিষ্ট অফিস/ব্যক্তিবর্গের কাছে। বৈঠক করেছেন। আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো কাল ইউজিসি। অবশেষে সেই সুসংবাদ এলো।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৭’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই বছরের ২৪ নম্বর আইন হিসেবে গেজেটভুক্ত হলেও কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। এর মাঝে উপাচার্য নিয়োগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু করার দাবিতে ফিশারিজ কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। এক পর্যায়ে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি কর্মস্থলে যোগদান করেননি।
ওই বছরের নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদকে উপাচার্য নিয়োগ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি যোগদান করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রেও মির্জা আজম, এমপি-এর প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা অব্যাহত। এর মাঝে নামেমাত্র লোকবল দিয়ে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। প্রথমবার ত্রিশালের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা-কার্যক্ররু করতে ভাড়া নেয়া হয় শহরের বঙ্গবন্ধু আইডিয়াল স্কুলের একটি ভবন। আস্তে আস্তে সিন্ডিকেটসহ সব বডি গঠন করে কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। দ্বিতীয় শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা হয় ঢাকার একটি কলেজে। এর মাঝে শুরু হয় মহামারী করোনা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া স্বত্তেও এই মহামারীতে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলো কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজটি’কে কেন্দ্র করে জামালপুরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এই কলেজটি বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে কলেজটি নিয়ে একটি জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনিশ্চয়তার ঘোর নামে কলেজের প্রায় তিন’শ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়েও। উদ্যোগী হন জননেতা মির্জা আজম, এমপি। এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরই মাঝে তাঁর প্রচেষ্ঠায় কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুশাসনও জারি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেয়। যথাযথ নিয়ম মেনে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগে আত্তীকরণের নির্দেশ দেয় সরকার। এর মধ্যদিয়ে স্বস্তি ফেরে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে। আলোর দেখা পান অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন বলে ‘নষ্ট’ করেছেন শিক্ষাজীবনের মূল্যবান সময়।
২০১৯ সালের ২৩ মে উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদের কাছে তৎকালীন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্ব মির্জা আজম, এমপি প্রতিষ্ঠানটির সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দলিল হস্তান্তর করেন। ফলে ১৫.৪৩ একর জমিসহ কিছু স্থাপনা পায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। তাই প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যেই ভাড়া ভবন থেকে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় সকল কার্যক্রম। ক্যাম্পাস হয় দৃষ্টিনন্দন। এর মাঝে চতুর্ভূজ আকারে একটি একাডেমিক ভবন করা হয়েছে। শূন্য থেকে শুরু। এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৭০০। শিক্ষক ৪৮ জন, কর্মকর্তা ৩০ ও কর্মচারী ১৫০-এর বেশি। এর মাঝে ফিশারিজ বিভাগের একটি ব্যাচের স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে ক্যাম্পাস স্থাপনে সরকার ৫০০ একর ভূমির অনুমোদন দিয়েছে। এরই আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যান। অদূর ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস আরও বিস্তৃত হবে। শিক্ষার্থী বাড়বে, নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে দেশি- বিদেশি গবেষকদের পদচারনায় মুখর হবে দৃষ্টিনন্দন সবুজ এই ক্যাম্পাস। চর্চা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের। গবেষণালব্ধ সেই নব্যসৃষ্ট জ্ঞানে দেশ-জাতির কল্যাণ হবে। এভাবেই বশেফমুবিপ্রবির নিজস্ব কৃষ্টি-ঐতিহ্য তৈরি হবে। এভাবেই শিখন-পঠনের মাধ্যমে মেধা ও মননে এক টুকরো বশেফমুবিপ্রবির আভা ছড়িয়ে যাবে ‘বিশ্বগ্রামে’।
শিক্ষার্থী-গবেষকদের আধুনিকজ্ঞানে যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিতসহ এক্সট্রা-কারিকুলার কার্যক্রম নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন আলহাজ মির্জা আজম, এমপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বপ্নদ্রষ্টা বলেন, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনায় ছিলো সবার জন্য কল্যাণমুখী শিক্ষা। এরই আলোকে বঙ্গমাতার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাদানের পাশাপাশি এখানে জাতীয় দিবস-উৎসব পালন করতে হবে। এভাবে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। আমরা চাই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজাতির মিলনভূমিতে পরিণত হোক। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গ্রাম ও এর মানুষদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটুক শিক্ষার্থীদের। উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে উঠকু মানবতাবোধের শিক্ষাও।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও জনসংযোগবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস