বিএনপি-আওয়ামী লীগ বুঝি না, মসিউর রহমানকে বুঝি
৩ নভেম্বর ২০২২ ১৭:২৩
নেতা বলতে আমরা মসিউর রহমানকেই চিনি ও জানি। শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাকে ওভাবেই চিনে এসেছি। মসিউর রহমান শুধু ঝিনাইদহের আঞ্চলিক কোনো নেতা ছিলেন না, তিনি বরং সমগ্র বাংলাদেশে পরিচিত একমুখ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিএনপির যে কয়েকজন জাঁদরেল নেতা আছেন বা ছিলেন এর মধ্যে মসিউর রহমানের নাম প্রথম সারিতে থাকার মতো।
তিনি টানা চারবার নির্বাচিত এমপি, ঝিনাইদহ-২ আসনে যার ছিল একক আধিপত্য। তবে রাজনৈতিকভাবে মসিউর রহমানকে জীবদ্দশায় বিএনপি খুব বেশি যে মূল্যায়ন করেছে— এমনটি বোধহয় বলা যাবে না। তিনি উপযুক্তভাবে মূল্যায়িত হলে একজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হতে পারতেন। মসিউর রহমানকে ঘিরে ঝিনাইদহের মানুষের অন্তত এই আশাটুকু সবসময়ই ছিল। সেই যোগ্যতা মসিউর রহমানের ছিল। তবে বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে হয়ত কোনো একসময় হতে পারতেন। বোধ করি এ কারণেই বলা হয় রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।
একসময় ছিল ঝিনাইদহ-২ আসন মানেই মসিউর রহমান। তিনি কাজ করেছেন একাধিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে, সর্বশেষ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
মসিউর রহমানের সঙ্গে দুইমাস আগে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। ঢাকায় এসে তিনি আমার সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য এরইমধ্যে ঢাকাতে এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখা করার বিষয়ে আমিও তাগিদ দিইনি আর। ভেবেছিলাম ডিসেম্বরে কোনো একসময় দেখা হবে, কথা হবে।
মসিউর রহমান ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চিন্তায় ছিলেন তার বিরুদ্ধে থাকা একাধিক মামলা নিয়েও। এ সব বিষয়েও তিনি দুশ্চিন্তার কথাও আমাকে বলেছিলেন। হয়ত দেখা হলে আরও অনেক আলাপ জমত আমাদের।
মসিউর রহমানকে মনে করা কিংবা স্মরণে রাখার অনেক কারণ আছে। আমি যে হাইস্কুলে পড়েছি ওই স্কুলে মসিউর রহমান এসেছিলেন। তাকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্বটি স্কুল থেকে আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কলেজে পড়ার সময়েও মসিউর রহমানের সঙ্গে একবার-দুইবার দেখাও হয়েছে। তার অফিসে গিয়েছি কলেজের বড় ভাইদের সঙ্গে।
মসিউর রহমান ঝিনাইদহে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করতেন। ওই পত্রিকাতে আমি লেখালেখি করতাম। পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডে ছিলেন আসিফ ইকবাল মাখন, সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন শাহীনুর আলম লিটন, পরে তপু রায়হান। মসিউর রহমান পত্রিকা অফিসে কখনও-সখনও যেতেন। লেখালেখি সূত্রেও মসিউর রহমানের প্রতি একধরনের আন্তরিক টানও অনুভব করেছি ওই সময়।
২০০৫ এর দিকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে একদল লোক তার পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করেছিল। ওই থেকে পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়।
ঝিনাইদহ-২ আসনে মসিউর রহমান সমান জনপ্রিয় ছিলেন। মূল কথা নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মসিউর রহমান আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য যে কোনো দলের কাছে ছিলেন এক হিসাব-নিকাশের নামও।
সরকারি কে সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠা করা বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে ঝিনাইদহের চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পরপর দুইবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একই ইউনিয়ন থেকে ১৯৮৭ সালে তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে ৭ মাস কারাভোগ করেন।
১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে ঝিনাইদহের এই আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। এরপর ১৯৯১, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, জুন ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে একই আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মসিউর রহমান। সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় তিনি বিরোধী দলীয় হুইপসহ সংসদীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
মসিউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অবস্থায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে ৮ নং সেক্টরে হরিণাকুন্ডু থানা কমান্ডার হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ঝিনাইদহ, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা, কুষ্টিয়া ও আলমডাঙ্গা থানার বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেওয়ার জন্যে ঝিনাইদহ আনসার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করেন ও সরকারিভাবে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন। তিনি ওই ক্যাম্পের কমান্ডার নিযুক্ত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী ঝিনাইদহে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করে তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করেন।
নিঃসন্দেহে মসিউর রহমান মাটি-মানুষের একজন নেতা। এমনও দেখা গেছে- তিনি মাঠে কর্মরত কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে কাদাজল ডিঙিয়ে চলে গেছেন, কৃষকদের সঙ্গে বসে খাবারও খেয়েছেন মাঠে। এসব লোক দেখানো কিছু ছিল না। এক সাদামাটা জীবন ছিল তার। রাজনীতিতে মসিউর রহমান মেকি কিংবা অভিনীত কিছু করেননি।
এলাকায় যতটুকু উন্নয়ন সবকিছুরই সূচনা মসিউর রহমানের হাতে সে কথাও চরম শত্রুও স্বীকার করবেন। ঝিনাইদহে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এসেছেন। একাত্তরের ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকীও ভোটে পরাজিত হয়েছেন মসিউর রহমানের কাছে।
২০০৮ সালের পর আসনটি চলে যায় মসিউর রহমানের নাগালের বাইরে। ২০০৮ এ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন শফিকুল ইসলাম অপু তবে তিনি এখন রাজনীতি থেকে অন্তরালেই বলা চলে। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও স্বতন্ত্র বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন তাহজীব আলম সিদ্দিকী। উঠতি নেতাদের মধ্যে এখন আছেন সাইদুল করিম মিন্টু। সবার বিরুদ্ধেই কমবেশি অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, গ্রুপিং, তৃণমূলকে মূল্যায়ন না করা এমনকি আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর অভিযোগও আছে কারও কারও বিরুদ্ধে। তবে নেতৃত্বগুণে এখনও কেউ মসিউর রহমানকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। সেক্ষেত্রে তারা মসিউর রহমানকে শিক্ষা হিসেবে নিতে পারেন। কেননা মসিউর রহমানের বড় গুণ ছিল দল-মত-নির্বিশেষ সবাইকে নিয়ে সমানতালে এগিয়ে চলার দক্ষতা। এই কারণে তার সময়ে জেলা বিএনপিতে ভাঙন দেখা দেয়নি, কখনও দুই রথে ওঠেনি রাজনীতি। শুধু তাই নয়, ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবেও মসিউর রহমান অবিসংবাদিত এক নেতা।
মূলত মসিউর রহমান কোণঠাসা হতে শুরু করেন ২০০৮ সালের পর। সেটি অনেকটা রাজনৈতিক কারণেই। ২০০৮ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর দুনীতির অভিযোগে মসিউর রহমানের নামে দূর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করে। জেলও খাটতে হয় তাকে। আইনি মারপ্যাচে মসিউর রহমান আর ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ১০ বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রায় দেন আদালত। পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
গত ১ নভেম্বর মারা যান মসিউর রহমান। এই দুঃসহ সময়ে মসিউর রহমানের মতো রাজনীতিবিদের আরও কিছু বছর বেঁচে থাকা বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি মানুষের কথা ভাবতেন, মাটির কথা ভাবতেন, ভাবতেন আগামী প্রজন্মের কথা।
মসিউর রহমান চাইলে বেগমপাড়ায় বাড়ি কিনতে পারতেন, চাইলে জমি দখল করতে পারতেন, চাইলে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করতে পারতেন। মসিউর রহমান চাইলে মামলা থেকে বাঁচতে পালিয়েও যেতে পারেন। তিনি তা করেননি। তিনি ঝিনাইদহের মাটি আঁকড়ে থেকেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
শুনেছি, শেষ বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার জন্য পরিবারের চাপ ছিল মসিউর রহমানের প্রতি। কিন্তু মসিউর রহমান সেদিকে তোয়াক্কা করেননি। তিনি পরিবারের কথা শোনেননি। ঢাকায় তার পরিবারের সদস্যরা থিতু থাকলেও মসিউর রহমান রাজধানী ছেড়ে ঝিনাইদহে পড়ে থাকতেন অধিকাংশ সময়। মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, এলাকায় যেতেন, নেতাকর্মীদের উদ্বুব্ধ করতেন। শেকড় ছাড়তে চাননি বলেই শহরের গীতাঞ্জলি সড়কে তার মৃত্যুটাও হয়েছে অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায়।
আমরা তর্কের খাতিরে, রাজনৈতিক আধিপত্যের খাতিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলকেই কেবল বুঝি। অনেক সময় অন্ধভাবেই তাদের মহিমা প্রচার করতে উদগ্রীব হই। কিন্তু দলের বাইরে চিন্তা করে প্রকৃত নেতাকে বুঝতে শিখি না কখনও কখনও। মসিউর রহমান কারও কারও কাছে এমনই ‘বুঝতে না পারা’ মহিমাময় এক নেতা।
আমি মনে করি তিনি কেবল কোনো দলের নেতা বা এমপি ছিলেন না। তিনি ঝিনাইদহের সর্বস্তরের নেতা, এমনকি গোটা দেশের প্রকৃত নেতাদের মাঝে একজন। একজন মানুষ হিসেবে, একজন নেতা হিসেবে যতখানি অনুকরণ-অনুসরণ করা যায়; মসিউর রহমানের মধ্যে সবটুকু গুণ ছিল বলে মনে করি। আমার মতো অনেকেই এই কথা বলবেন, বিএনপি বুঝি না, আওয়ামী লীগ বুঝি না; কেবল মসিউর রহমানকে বুঝি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কবীর আলমগীর বিএনপি-আওয়ামী লীগ বুঝি না- মসিউর রহমানকে বুঝি মুক্তমত