তারুণ্যের উন্মাদনা ভালো কিন্তু অতিরিক্ত উন্মাদনা খারাপ
১০ নভেম্বর ২০২২ ১৬:০৩
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে, তা দিনকে দিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কয়েকটা দেশ ও খেলোয়াড়ের সমর্থকদের কারণে গোটা বিষয়টা একধরনের ফুটবলতিক্ততা জন্ম দিচ্ছে।
বিশেষ করে খেলার মৌসুম বা ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে এলেই চিহ্নিত দলগুলোর সিংহভাগ সমর্থকদের কাদা ছোড়াছুড়ি, পরস্পর-পরস্পরের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ, অশালীন মন্তব্য প্রকাশ, এক খেলোয়াড়কে শ্রেষ্ঠ করতে গিয়ে অন্য খেলোয়াড়কে নিকৃষ্ট আখ্যা দেওয়া- ইত্যাকার কর্মকাণ্ড অসহ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে।
আলোচিত ফুটবল দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার উর্ধ্বে নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রে অবস্থান করছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। এই দুই দলের প্রতি উন্মাদনা বিশেষ করে উপমহাদেশের ফুটবল প্রেমীদের মাঝে চোখে পড়ার মতো। এই সমর্থকদের বিশাল একটা অংশ আবার তরুণ প্রজন্ম।
ইংরেজি নয় বর্ণের আর্জেন্টিনা আর ছয় বর্ণের ব্রাজিল সমর্থকদের অবস্থাটাও এখন নয়-ছয় পর্যায়ে। এই দুটো দলের বাংলাদেশি সমর্থকদের বিশাল একটা অংশ রীতিমতো একে-অপরকে খোঁচাখুঁচি, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্কের বাটখারায় একে-অপরের পাল্লা ভারি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের বাকযুদ্ধ অনলাইনে রূপ নিয়েছে কিবোর্ড যুদ্ধে। তারা অনেকেই মনে করেন, একদিন এই কিবোর্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তাদের প্রিয় দলকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দেবে।
আবার অনেক যায়গায় কিবোর্ড যুদ্ধ পরিণত হয়েছে সম্মুখযুদ্ধে। সংঘর্ষের রাজধানী খ্যাত একটি বিশেষ যায়গা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রত্যেকটা যায়গায় ফুটবল উন্মাদনা এখন রূপ নিয়েছে সহিংসতায়। বছর কয়েক আগে খুলনাতে এক ফুটবল সমর্থক দম্পতিকে মারাত্মকভাবে কুপিয়েছিল তাদের বিপক্ষ সমর্থকেরা। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কিছু স্থানে মানুষ নিহত হওয়া থেকে শুরু নানা রকমের অপ্রীতিকর ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা হরহামেশা ঘটেই চলেছে, সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় খোঁচাখুঁচি তো আছেই। এই যে পছন্দের-অপছন্দের দল খেলায় জিতলে কিংবা হারলেই আপনারা যারা পক্ষে-বিপক্ষে খোঁচাখুঁচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, উস্কানিমূলক আচরণ করছেন অথচ ভাবছেন আপনাকে দিয়ে উগ্রতা বা সহিংসতা আশা করা যাবেনা! দুদিন পর আপনিও যে অন্যের ঘাড়ে কোপ দিয়ে বসবেন না- তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই!
আপনাদের এসব কিছুই প্রমাণ করে, আমাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জগতটা এখনো বিকশিত হয়নি। সহনশীলতা তো দূরের কথা, আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানেই পৌঁছাতে পারিনি! আপনার কিংবা আমার সমর্থনের উন্মাদনা যখন অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তখন বুঝে নিবেন আপনি কিংবা আমি সমর্থক নই- সহিংসতার পর্যায়ে আছি।
ধরুন, ব্যক্তিগতভাবে আমি লিওনেল মেসির ভক্ত। এখন আমাকে মেসি ভক্ত হওয়ার জন্য নেইমারের বিরুদ্ধাচারণ করতে হবে- এমনটা কিন্তু নয়! অথবা ধরুন, আমি দলের দিক থেকে ব্রাজিলের সমর্থক। ব্রাজিল সমর্থক হয়েছি বলে আর্জেন্টিনার বিজয়ে আমাকে কটুক্তি করতে হবে- এমনটাও তো না! একজন খেলোয়াড় যখন ভালো খেলে, একটা দল যখন ভালো কিছু উপহার দেয়- অবশ্যই তারা প্রশংসার দাবিদার। গুণ ও গুণীর কদর তো করতেই হবে। এতটুকু কৃতজ্ঞতা ও সহানুভূতিবোধ তো আশা রাখা যেতেই পারে! এই যে পছন্দের ভিন্নতা, সমর্থনের ভিন্নতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ- এগুলো থাকবে। আপনি না চাইলেও থাকবে। এটা যদি আপনি মেনে নিতে না পারেন, নিজের ভেতরে প্রয়োগ করতে না পারেন তাহলে বিশ্বাস করুন ফুটবলের প্রেমে পড়ার, ফুটবল খেলা দেখবার কিংবা বুঝবার মতো পরিপক্বতা ও মানসিকতা আপনার কোনোটাই তৈরি হয়নি। চালানো না শিখেই সড়কে গাড়ি নিয়ে ওঠা যেমনটা ভয়ংকর, ঠিক তেমন ফুটবলের সৌন্দর্যের জন্যও আপনি ক্ষতিকর।
আপাতদৃষ্টিতে ফুটবল কেন্দ্রিক উন্মাদনা এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে তা আমাদের জাতীয়তাবাদ ও ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অজ্ঞতাবশত সমর্থকগুলো নিজেদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করছে, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর কিছু নয়। বিশেষ করে দিনকে-দিন আমাদের তেজদৃপ্ত তরুণরা আবেগ ও উন্মাদনাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রয়াত নেতা মইন উদ্দীন খান বাদল একবার বলেছিলেন, ‘তারুণ্যের উন্মাদনা ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত উন্মাদনা খারাপ।’
লেখক: শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
তারুণ্যের উন্মাদনা ভালো কিন্তু অতিরিক্ত উন্মাদনা খারাপ মুক্তমত শিশির ওয়াহিদ