ভিনদেশি পতাকা উড়ানোর আগে পতাকাবিধিমালা জানুন
১০ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৩১
আগামী ২০ নভেম্বর পর্দা উঠছে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের। প্রথমবারের মতো ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরের আয়োজক হয়েছে কাতার। ইতিমধ্যে ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ফুটবল টিম জায়গা করে নিতে না পারলেও ফুটবল বিশ্বকাপের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র ব্যাপৃত। বিশ্বকাপ এলেই যেন বাংলাদেশে একটি নতুন উৎসব শুরু হয়। বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগ থেকেই শুরু হতে থাকে এ উৎসব । চায়ের কাপে , আড্ডায় সবখানে এক টপিক- বিশ্বকাপ ফুটবল । এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয় ফুটবল খেলুড়ে দেশগুলো হচ্ছে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মান, ফ্রান্স ও পর্তুগাল। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ফুটবল ভক্তদের দেখা যায় প্রিয় দলের পতাকা উড়িয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে ও উড়াতে পারে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। যে যার ইচ্ছে মতো জাতীয় পতাকা বানানো বা উড়ানোর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এদের অধিকাংশই জাতীয় পতাকার মর্যাদা ও এটি উড়ানো বা বানানোর নিয়মনীতি সম্পর্কে অনবগত। সাধারণত দেখা যায় বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পূর্বে সমর্থকরা নিজের পছন্দের দলের পতাকা বানিয়ে উড়াতে শুরু করেন। অবস্থা এমন হয়ে যায় যে কোনো ভীনদেশী নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিজের অবস্থান, কোনদেশে এসেছেন, এ সম্পর্কে শংকিত থাকেন। পতাকা উড়ানোর সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে উড়ানো। কেউ কেউ নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে একটি চতুরতার আশ্রয় অবলম্বন করেন। তারা প্রিয় দলের পতাকার উপর একটি ছোট আকৃতির বাংলাদেশ পতাকা বেঁধে দেন। এই পতাকা সকাল-সন্ধ্যা, দিনরাত, ঝড়বৃষ্টিতে উড়তে থাকে। অথচ স্পষ্ট নিয়ম রয়েছে সূর্যাস্তের আগে পতাকা নামিয়ে ফেলার। অপরদিকে দুটি পতাকা একটির উপর আরেকটি বা একটির নিচে আরেকটি উড়িয়ে দুটো পতাকাকেই অবমাননা করা হয়।
জাতীয় পতাকা হচ্ছে একটি দেশের গৌরব ও সম্মানের বিষয়। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, আদর্শ ও প্রতীক হিসেবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই জাতীয় পতাকা রয়েছে । জাতীয় পতাকার সুনির্দিষ্ট আয়তন , উত্তোলনের নিয়ম সুস্পষ্টভাবে সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত আছে। এর ব্যতিক্রম হলে তথা অবমাননা করা হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়৷ এজন্য জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষা ও অবমাননা রোধে জাতীয় পতাকা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
জাতীয় পতাকার আয়তন—
গাঢ় সবুজ রঙের আয়তাকার ক্ষেত্রের মধ্যে লাল রঙের ভরাট বৃত্ত সম্বলিত আমাদের জাতীয় পতাকার স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত হবে- ১০:৬ । ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন হবে ১০:৬’ বা ৫:৩’ বা ২:১’। ভবন ব্যতীত গাড়ীতে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন হবে ১৫’ গুণ ৯’’(বড় গাড়ীর জন্য) বা ১০’’ গুণ ৬’’(মাঝারি বা ছোট গাড়ীর জন্য)। এছাড়া আর্ন্তজাতিক কনফারেন্স বা দ্বি-পক্ষীয় আলোচনার জন্য টেবিল পতাকার আয়তন হবে ১০:৬।
কোন কোন ভবন সমূহে এবং কোন কোন দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে?
সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ভবন ও অফিস সমূহ যেমন- রাষ্ট্রপতির বাসভবন, সংসদ ভবন, হাইকোর্ট ও জেলা ও দায়রা জজ আদালত সমূহ, সচিবালয়, কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগার সমূহ, পুলিশ স্টেশন সমূহ প্রভৃতি স্থানে প্রত্যেক কার্য দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে। এছাড়া, বিশেষ দিবস সমূহ যেমন- মহানবী (সঃ) এর জন্ম দিবস, ২৬-শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬-ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস সহ সরকারী প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত অন্যান্য দিবস সমূহে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারী- বেসরকারি ভবন সমূহ ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন সমূহের অফিসগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত থাকবে।
কোন কোন ব্যক্তিবর্গ তাদের মোটর গাড়ী ও জলযানে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলনের অধিকারী হবেন?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীবর্গ ও সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ উক্ত মোটর গাড়ী ও জলযানে শুধুমাত্র তাঁদের ভ্রমণ কালীন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকারী হবেন। উল্লেখ্য, ‘৭২ সালের ফ্ল্যাগ রূলসের মাধ্যমে কোন সংসদ সদস্য বা সিটি মেয়রদের তাদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকার প্রদান করে নি।
জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার্থে পতাকা বিধি প্রদত্ত নির্দেশাবলী—
সর্বদা জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শণ করতে হবে;
পতাকা দ্বারা মোটর গাড়ি, রেলগাড়ী, নৌকা বা অন্য কোন যান বাহনের সামনের ভাগ, পিছনের ভাগ বা পার্শ্ব ভাগ আচ্ছাদিত করা যাবে না;
যেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকার জন্য স্থান(place of honour) সংরক্ষিত থাকবে;
যেক্ষেত্রে দুটি পতাকা অথবা রঙিন পতাকা উত্তোলিত হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা ভবনের ডান দিকে উত্তোলিত হবে;
বাংলাদেশের পতাকার উপরে অন্য কোন দেশের পতাকা বা অন্য কোন রঙিন পতাকা উত্তোলন করা যাবে না;
বাংলাদেশের পতাকা শোভাযাত্রার মধ্যভাগে বহন করতে হবে অথবা সৈন্যদলের অগ্রগমন পথে ( Line of March) শোভাযাত্রার ডান দিকে বহন করতে হবে;
যেক্ষেত্রে অন্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা একত্রে উত্তোলন করা হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা প্রথমে উত্তোলিত হবে এবং নামাবার সময় সর্বশেষে নামাতে হবে;
যেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা অর্ধনমিত থাকে, সেক্ষেত্রে প্রথমে পতাকাটি সম্পূর্ণরুপে উত্তোলন করে অর্ধনমিত রাখা হবে এবং পতাকা নামানোর সময় পুনরায় পতাকাটি চূড়া পর্যন্ত উঠিয়ে তারপর নামাতে হবে;
কবরস্থানে জাতীয় পতাকা নিচু করা যাবে না বা ভূমি স্পর্শ করানো যাবে না; পতাকা কখনোই মেঝেতে, ভূমিতে, পানিতে বা সমতলে স্পর্শ করানো যাবে না;
জাতীয় পতাকা কোন কিছুর আচ্ছাদন হিসাবে ব্যাবহার করা যাবে না তবে কোন ব্যক্তিকে যদি পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাহলে তার কফিনে জাতীয় পতাকা দ্বারা আচ্ছাদন করা যেতে পারে;
পতাকা এমন ভাবে ব্যাবহার করা যাবে না যাতে পতাকা ছিড়ে যায় বা অন্য কোন ভাবে ময়লা বা নষ্ট হয়; এছাড়া সরকারী অনুমোদন ছাড়া ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে পতাকা কোন ট্রেড মার্ক,ডিজাইন, শিরোনাম বা অন্য কোন প্যাটেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না;
পতাকা দ্রুততার সাথে উত্তোলন করতে হবে এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে নামতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে বাংলাদেশে বিদেশি পতাকা ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছিলো । ওই রিট আবেদনে বলা হয়, ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের বাংলাদেশি সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করেন। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলো ছাড়া অন্য কোনো স্থানে অন্য রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
মোদ্দাকথা হলো, বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে পতাকা উড়ানোর যে নিয়ম অনুসরণ করা হয় তাতে প্রথমত, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়। দ্বিতীয়ত, অনুমোদন ছাড়াই বিদেশি পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পতাকাবিধিমালাকে লঙ্ঘন করা হয়।
ফুটবল বিশ্বকাপ প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়ে যে উন্মাদনা আর উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাতে আবেগের একটি প্রভাব থাকবে সমর্থকের মনে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের পতাকা কিংবা আইনের চেয়ে ফুটবলের প্রতি আবেগ কখনোই বড় কিছু নয়। এই পতাকার পেছনে আমাদের সংগ্রাম ও জাতীয় চেতনাকে লালন করে জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
দেওয়ান রহমান ভিনদেশি পতাকা উড়ানোর আগে পতাকাবিধিমালা জানুন মুক্তমত