Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সৃজনশীল প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার সৃজনশীল নমুনা

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৫:২২

মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাস বলে দেয় যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একত্রে বসবাস করে এসেছে। হিন্দু কিংবা মুসলমান শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষ বাধেনি। তাহলে ধর্মীয় বিদ্বেষে ছড়ায়ে কবে থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল? প্রশ্ন জানার আগে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ইতিহাসে দেখা গেছে যে হিন্দু ও মুসলমানসহ সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া খাওয়া করেছিল। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের মানুষ বনের পশু কিংবা মাছ এক সাথে শিকার করে কাঁচায় কিংবা আগুনে ঝলসে খেয়েছিল। জমিতে ফসল উৎপাদন করার ক্ষেত্রেও ছিল একতাবদ্ধ।

পূর্বপুরুষদের সম্প্রীতির ওই সংস্কৃতি গ্রামের মধ্যে এখনও দেখা যায়। নদীতে যখন মানুষ মাছ ধরতে যায় তখন কোনো জাতপাতের বিষয় থাকে না। হাটবাজারে কেনাকাটায় কোনো ধর্মের বিভেদ থাকে না। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কোনো ধর্মের বিভাজন করা হয় না। ফলে আমরা বলতে পারি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশেষ মেলবন্ধন নিয়ে মানবজাতির বসবাস। কিন্তু কালের পরিক্রমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিলুপ্তির পথে!

আজ উদ্বিগ্নতার সাথে বলতে হয় এখন খোঁজা হয়। কে হিন্দু? কে মুসলমান? মোদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যেন ঊর্ধ্বমুখি। এ দেশ যখন পাকিস্তানের দখলে ছিল তখন দেখা যেত ধর্মের নামের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছিল অহরহ। তাহলে এতক্ষণে আপনারা হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন যে কারা প্রথম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরী করেছিল? এ সহিংসতার শেষ টা কবে?

ভারতবর্ষের মানুষ ব্রিটিশদের শাসনামল কখনও ভুলতে পারবে না। কারণ ব্রিটিশদের শাসন আমলে শাসকদের মূল লক্ষ্য ছিল ভাগ কর শাসন কর। যত বেশি হিন্দু বনাম মুসলমানের মধ্যে সংঘাত করতে পেরেছিল তখন বেশি ব্রিটিশরা শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। তাহলে সাম্প্রদায়িকতার শুরুটা কোথায় থেকে বুঝতে পারছেন। শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য থাকে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা।

ফলে যারা ধর্মের নামে ব্যবসা করে তারা হলেন ধর্মব্যবসায়ী। এরা ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মকে ব্যবহার করে লুণ্ঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার ভূত তাড়াবে কে? একদিকে সাম্প্রদায়িকতার ভূত আর অন্য দিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ভূত জোট হয়ে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কথাটা এমন করে বলতে হয় সরষের মধ্যে ভূত থাকলে তাড়াবে কে? শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের শিক্ষক সমাজ সেই মেরুদণ্ডের ভিত্তি স্তর শক্তিশালী করেন। অন্ধকার সমাজকে আলোর পথ দেখায় শিক্ষক সমাজ। এমনকি সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেবেন। এটিই শিক্ষকদের কাছে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ প্রত্যাশা করে।

কিন্তু শিক্ষক সমাজের মুষ্টিমেয় শিক্ষকের চরিত্র যেন উল্টো কথা বলে। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে একজন কেন্দ্র সচিব ও প্রধান শিক্ষকসহ তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তারের খবর আমরা দেখেছিলাম। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড।

করোনা মহামারীতে শিক্ষার্থীদের জীবন নাস্তানাবুদ তার মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস। যার ফলে এ বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মহাবিপদ তৈরী করেছিল। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ওই বোর্ডের অধিকাংশ পরীক্ষার্থী লেখাপড়ায় অনিয়মিত হয়ে পড়ে এতে করে খারাপ ফলাফলের আশংকায় ভুগছেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের দায় কার?

পুরোনো কথায় আবারও নতুন ভাবে বলতে হয় যে আমাদের দেশে দুর্নীতি কতটা প্রসারিত হয়েছে তা বুঝা যায় প্রশ্নফাঁস চক্রের সাথে যারা জড়িত তাদের হাত কতটা শক্তিশালী হলে সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। জাতিকে কলঙ্কিত ও দূষিত করছে কলম চোর নামে কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ। যার কারণে খুবই দুঃখজনক, লজ্জার এবং বিব্রতকর ঘটনায় পড়েছে গোটা জাতি। যেন ঘুণে ধরেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। বাজারের পণ্যের মত শিক্ষাপদ্ধতি যে টাকা ছাড়া শিক্ষা পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষায় ব্যস্থায় নতুন ভূত নেমেছে তাহচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা বিষয় দেশেজুড়ে সমালোচনা ঝড় চলছে।

তার মধ্যে গত ৬ নভেম্বর শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমানের ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্ন অনুসারে দেখা যায়, ১১ নং প্রশ্নের উদ্দীপকে বলা হয়েছে, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘ দিন। অনেক শালিস বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আবদুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আবদুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। কুরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কুরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছু দিন পর কাউকে কিছু না বলে জায়গা জমি ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বাংলা (আবশ্যিক) প্রথমপত্রে কাসালং সেটের ১১ নম্বর ক্রমিকে নাটক সিরাজউদ্দৌলার সৃজনশীল প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানদের জীবনাচরণের কিছু চিত্র তুলে ধরে এই প্রশ্নের উদ্দীপকে কিছু বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এ রকম উদ্ভট উদ্দীপক দিয়ে ক থেকে ঘ পর্যন্ত আরও উদ্ভট প্রশ্ন করা হয়েছে।
প্রশ্নের ধরণ হচ্ছে—

ক. মিরজাফর কোন দেশ হতে ভারতে আসেন?

খ. “ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব”−ব্যাখ্যা কর।

গ. উদ্দীপকের ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার নাটকের ‘মিরজাফর’ চরিত্রের তুলনা কর।

ঘ. “খাল কেটে কুমির আনা” প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য−উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর।

পাবলিক পরীক্ষার এমন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টি উস্কানিমূলক প্রশ্ন কেন করা হয়েছে? উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ‘সপরিবারে ভারত চলে যাওয়া’ ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘মিরজাফর’ চরিত্রের তুলনা করা হবে? উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এসে আমরা শিক্ষার্থীদের কি শিখাচ্ছি? ধর্মের কৌশল অবলম্বন করে সম্পদ লুট করা, এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো এগুলো কি আমাদের শিক্ষার পদ্ধতি।

যতই মুখে স্লোগানে বলি যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তব চিত্র গুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যায় যখন দেখি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়ে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা গলায় পড়ানো হয়, যখন দেখি বিজ্ঞানের শিক্ষককে কারাগারে বন্দি করা হয় তখন উদ্বিগ্নতার সাথে বলতে হয় সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে সামপ্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়ে গেছে ভাইরাসের মত। শিক্ষায় জাতি কতটুকু নিচে নেমে গেলে এরকম প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিকৃত মানষিকতায় গড়ে তোলা হয়।

সমাজের সর্বব্যাপী অবক্ষয়, ঘুষ-দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের প্রধাণ কারণ মানহীনতা শিক্ষাপদ্ধতি, নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপরাজনীতি। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ এবং পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাসীনদের দলীয় আধিপত্য শিক্ষার মানহীনতা, অনৈতিকতা ও অবক্ষয়ের জন্য দায়ী।

সময় এসেছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, নিবিড় পরিচর্যায় প্রশ্নপত্র ফাঁস- সাম্প্রদায়িকতার ভূত তাড়ানোর জরুরি।রাষ্ট্রের অবক্ষয়, দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাখাতে ঘুষ-দুর্নীতি ও অপরাজনীতি থেকে মুক্ত করতে হবে৷ সর্বক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যদের দায়িত্বশীল পদে বসাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বচ্ছ ও রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ সৃজনশীল প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার সৃজনশীল নমুনা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর