সেলফি তোলা যেন মৃত্যুর কারণ না হয়!
১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩৪
সম্প্রতি সেলফি তোলা যেন একটি মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। যেখানে-সেখানে, সময়ে-অসময়ে সেলফি নিতে গিয়ে অনেককে নানান বেকায়দায়ও পড়তে হয়েছে। এভাবে সেলফিমুখী যুব সমাজ যেন মানসিক ব্যাধিতে সংক্রমিত হয়ে প্রাত্যহিক জীবনকে নানা ভাবে ব্যাহত করে আসছে।
সেলফি তোলার এমন উদ্দীপনা যেন মহামারি ভাইরাসের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। যা সমাজে সেলফাইটিস ভাইরাস নামে পরিচিতি লাভ করেছে। যুব সমাজে লক্ষনীয় এই সেলফাইটিস ভাইরাস যেন ধর্মীয় বিধিনিষেধকেও ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি সেলফাইটিস ভাইরাসে সংক্রমিত উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রসমূহ– হজ্জে গিয়ে সেলফি, নামাজে সেলফি, জানাজায় সেলফি, লাশের পাশে সেলফি, মৃত্যু শয্যার পাশে সেলফি, খুনের পাশে সেলফি, ইফতারির পাশে সেলফি, তারাবির সেলফি, জুমআ নামাজের সেলফি, দোয়া/মিলাত/খতমের সেলফি ইত্যাদি। এমনকি এই সেলফাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কবরও রেহাই পায়নি।
সম্প্রতি এক শ্রেণির ভদ্রলোককে কবরের পাশেও সেলফিবন্ধী হতে দেখা গিয়েছে। এভাবে বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক মূল্যবোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
এমনকি এই সেলফাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেক ভদ্রলোকের প্রাণেরও বিনাশ ঘটেছে। শুধু তাই নয় সেলফাইটিস ভাইরাস খালি করেছে অনেক মায়ের বুক। এছাড়াও বর্তমান যুব সমাজ সোশ্যাল মিডিয়ার ঘূর্ণাবর্তে বেড়ে উঠছে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোতে তাদের অবাধ বিচরণ বেড়েছে। যেমন– ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক সহ ইত্যাদি সাইটে তারা ছবি আপলোড করে থাকে, যেখানে লাইক-কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাওয়ার লোভে অনেকেই মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও সেলফি উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। যার ফলাফল অনেক সময় আকস্মিক মৃত্যু ডেকে আনছে।
সমাজে এমনও অনেক ভদ্রলোক আছেন, যারা নিজেদের প্রকাশ ও লাবণ্যময়ী, সুদর্শন চেহারার জানান দিতে জীবন ঝুঁকি নিয়ে সেলফি উঠাতেও দেখা যায়। অথচ এমন প্রকাশের ভঙ্গিমাতে অনেকগুলো প্রাণ প্রতিনিয়তই ঝরে পড়ছে। বিপজ্জনক সেলফি উঠানোর মাধ্যম হিসেবে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত স্থান সমূহের মধ্যে আছে– রেলের ট্র্যাকের উপর সেলফি, কুমিরের সাথে সেলফি, বুনো হাতির সাথে সেলফি, চলন্ত ট্রেনের ছাদে সেলফি, পাহাড়ের চূড়ায় সেলফি, থুতনিতে বন্দুক ঠেকিয়ে সেলফি, বাদরের সাথে সেলফি ইত্যাদি। এসব ঝুঁকি নিয়েও প্রতিনিয়ত সেলফাইটিস ভাইরাসের শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজারো ভদ্রলোক। এই সেলফাইটিস ভাইরাসের কবলে পড়ে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়তই প্রাণের বিনাশ ঘটে চলেছে।
এছাড়াও দুর্গম এলাকায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি উঠাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও বারবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। তবুও সেলফাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে, যেখানে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে অন্তত ২৫৯ জন সেলফাইটিস ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। যেখানে হাঙ্গরের মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে ৫০ জন।
ভারতের জার্নাল অব ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ারের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে সেলফি আসক্তি বেশি। কিন্তু পুরুষেরা আবার বেশি ঝুঁকি নিয়ে সেলফি তুলতে ভালোবাসেন। ফলে পানিতে ডুবে, সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা খাদে পড়ে প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার।
আরও জানা গেছে, সেলফিতে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ভারতে। এখনো পর্যন্ত সেই সংখ্যা ১৫৯ জন। তবে শুধু সেলফি নয়, গ্রুপি অর্থাৎ একসঙ্গে অনেকজন ছবি তুলতে গিয়েও দূর্ঘটনা ঘটিয়েছেন ভারতীয়রা। কখনো ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন আবার কখনো বা গভীর পানিতে নৌকা উল্টেও প্রাণ হারিয়েছেন। দূর্ঘটনা রুখতে দেশটির বিভিন্ন স্থানকে ‘নো সেলফি জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু মুম্বাইয়েই এরকম ১৬ টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও এমন সেলফাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যেখান থেকে পরিত্রাণ না পেলেই অকালে ঝরে যাবে অসংখ্য প্রাণ। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানের বিপজ্জনক পয়েন্টে সেলফি নিতে গিয়ে প্রাণ হারানোর শিরোনাম উল্লেখযোগ্য।
তবে বাংলাদেশ, ভারতের বাইরেও ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, জার্মানি, তাইওয়ান এবং রাশিয়ার মতো দেশেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে সেলফাইটিস ভাইরাস। এসব দেশেও সেলফাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে।
সর্বোপরি এমন মানসিক ব্যাধি হতে পরিত্রাণের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে পারিবারিক মূল্যবোধ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সহ ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন অত্যাবশ্যক। কেবল তবেই সেলফাইটিস ভাইরাসের ন্যায় সমাজের নানা কীট অপসারিত হবে এবং সমাজ সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এজেডএস