প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যনীতি কাম্য নয়
১৭ নভেম্বর ২০২২ ১৯:২৬
সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে কিংবা বিশ্বাস করে আসছি যে শিক্ষকতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এক পেশা বা দায়িত্ব। যে পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে সমাজে কিংবা দেশের নাগরিকরা সম্মানের চোখে দেখে। পরম শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে এবং ভালোবাসায় আগলে রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই রাষ্ট্র কি শিক্ষকদের প্রকৃত সম্মান দিতে পেরেছে? তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পেরেছে? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বলাবাহুল্য যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের যাবতীয় যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। চাই সেটা আর্থিকভাবে হোক কিংবা অন্য যেকোনো মাধ্যমে হোক। সেই তুলনায় আমাদের দেশের এই মহান পেশায় নিয়োজিত মানুষগুলো সুযোগ সুবিধা কম পেয়ে থাকেন। যা এই জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনার ও দুঃখের বিষয়। কেননা, জাতির কান্ডারী তারাই, তাদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের মাধ্যমেই শিশুরা আগামীর জন্য গড়ে উঠবে।
আমাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষাজীবন শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের আগামীর জন্য গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। একজন শিক্ষকের কাজ মোটেই সহজ নয়। তিনি যে শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন তা কিন্তু নয় বরং তিনি তাদের শেখান এই দেশ সম্পর্কে, এই বিশ্ব সম্পর্কে। তাদের শেখান এই সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে তথা এই পৃথিবীতে চলতে গেলে কোন কাজ করা উচিত আর কোন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত সেসব বিষয়ে। এক কথায় বলতে গেলে, প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে কিংবা সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে যে শিক্ষা দিয়ে থাকেন তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই প্রাইমারির শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্র কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন জাগে। প্রাইমারি একজন শিক্ষক মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করে চাকরিতে যোগদান করে। বেতন পায় ১৩তম গ্রেডে। এখানেই আপত্তি আছে। আপত্তির জায়গাটি হল, প্রাইমারি শিক্ষকদের মতো একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতরা বেশি বেতন পেয়ে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, উপ-সহকারী কৃষি অফিসার পদে নিয়োগ যোগ্যতা এসএসসি ( ৩/৪ বছরের কৃষি ডিপ্লোমা ) নিয়ে ১০ম গ্রেডে বেতন পান। পূর্বে ইউনিয়ন সচিব পদে নিয়োগ যোগ্যতা ছিল এইচএসসি। বর্তমান সময়ে স্নাতক সম্মান শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ১০ম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পদে একই শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ১০ম গ্রেডে বেতনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, প্রাথমিক শিক্ষকরা কেন ১৩তম গ্রেডে বেতন পাবেন? এটা কি তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নয়? এমন বৈষম্য নীতির ফলে শিক্ষকরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। কেননা, এমন গ্রেডের বেতনে বর্তমান সময়ে সমাজে টিকে থাকা কিংবা সংসার চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের এই প্রাথমিক শিক্ষকরা যদি আর্থিকভাবে কিংবা সার্বিক দিক থেকে সচল না থাকেন তাহলে তারা শ্রেণিকক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে পাঠদান দিতে পারবে না। কারণ তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্থ। বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে সবকিছুতে যে হারে দাম বেড়েছে এতে করে তাদের জীবন যাপন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একটা ছোট্ট হিসেব দেওয়া যাক। ধরুন, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মূল বেতন ১১,০০০ টাকা। বিভিন্ন ভাতাসহ ১৩ তম গ্রেডে সর্বসাকুল্যে ১৯, ৩০০ টাকা পেয়ে থাকেন। তবে অঞ্চল এবং ডিপার্টমেন্ট ভেদে কিছু টাকার তারতম্য হতে পারে বা হয়ে থাকে। একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের এই সীমিত আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ বহন করতে হয়। কোন কোন পরিবারে অসুস্থ বয়স্ক লোক থাকে, তাদের চিকিৎসা খরচসহ ওষুধ পত্রের খরচ চালাতে হয়। তারপর আরো আনুষাঙ্গিক বিষয় তো আছেই। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সময়ে এই সীমিত আয় দিয়ে এত কিছু সামলানো কি আদৌ সম্ভব ? কিন্তু প্রাইমারির শিক্ষকরা নিরুপায় হয়ে কষ্টে তা সহে যাচ্ছে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ২৯ হাজার টাকা প্রদান করে থাকে। ( আনন্দবাজার পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী ) আর সেই জায়গায় আমাদের দেশের প্রাইমারি শিক্ষকদের ১৯, ৩০০ টাকা দেওয়া হয়। তাহলে এমন বৈষম্য নীতিতে শিক্ষকরা কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে পাঠদান করাবেন? কীভাবে শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা অর্জন করবে? তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
প্রাইমারি শিক্ষকদের আরেকটি আক্ষেপের বিষয় হলো, ২০১৯-এর খসড়া নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থিতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা বলতে গেলে এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। অর্থাৎ বলা যায় এটি সহকারী শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে।
আমি মনে করি যে এই, শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বিভাগীয় প্রার্থিতার বিকল্প নেই। অথচ দেশের সরকারি সব দপ্তরেই এই সুবিধা চালু আছে। কিন্তু এখানেই সব বাধাবিপত্তি। এটির মাধ্যমে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী শিক্ষকরা অনেকেই প্রধান শিক্ষক, এটিইও, পিটিআই এর ইনস্ট্রাক্টর ইত্যাদি পদগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। যার ফলে সবার মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা মনোভাব দেখা যেত, পড়াশোনায় মনোযোগী হতো। আর যদি বিভাগীয় প্রার্থিতার সুযোগ না থাকে তাহলে সহকারী শিক্ষক পদটি একটা ব্লক পোস্টে পরিণত হয়ে যাবে। যা শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত না করে বরং তাদের মানসিক চাপে রাখবে। এতে করে মেধাবী শিক্ষকরা নতুন করে যোগদান করতে আগ্রহ হারাবে। সেই সাথে তারা তাদের পড়াশোনার উৎসাহ হারাবে এবং শিক্ষাদানে ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। একটা কথা লক্ষণীয় যে, শিক্ষার্থীদের মূলভিত্তি তৈরি হয় এই প্রাইমারি স্কুল থেকে। আর যাদের হাতে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি স্থাপনের চাবি তাদের প্রতি যদি অবহেলা আর বৈষম্য নীতি গ্রহণ করা হয় তাহলে এর প্রভাব সারা জীবন শিক্ষার্থীদের জীবনে বহন করে বেড়াতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সারাদেশের শিক্ষকরা মিলে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সরকারের নিকট তাদের দাবি সম্পর্কে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনগুলো আলাদা হলেও তাদের দাবিগুলো একই সূত্রে গাঁথা। বিশেষ করে গত ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় শহীদ মিনারে লক্ষাধিক শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। তখন প্রধান শিক্ষকদের ১১তম, সহকারী প্রধান শিক্ষকদের ১২তম ও সহকারী শিক্ষকদের ১৩ গ্রেড প্রদানের ঘোষণা দেয় সরকার। তবে প্রাইমারি সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা। এই জায়গায় একটা আপত্তি আছে। সেটি হলো, প্রাইমারি স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদটি সম্পূর্ণই অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত বলা যায়। এর কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। মূলত সহকারী শিক্ষকদের পিছিয়ে রাখার জন্য এটি একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করি। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরাও তাঁদেরকে ১০ম গ্রেড প্রদান করার জন্য দাবি জানাচ্ছেন। তবে অনেকেই মনে করছেন এই দাবি অযৌক্তিক। যেহেতু প্রধান শিক্ষকরা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১০ম গ্রেডে থাকবেন তাহলে সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড ১০ম হবে কীভাবে! অর্থাৎ প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড একই হতে পারেনা। এই জায়গায় একটু বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন। প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে থাকলে সহকারী শিক্ষকদেরও ১০ম গ্রেড প্রাপ্তিতে কোন বাঁধা নেই। কেননা, সর্বশেষ নিয়োগ বিধি অনুযায়ী প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একই। তাই দুটি পদ একই গ্রেডভুক্ত হতে আইনগত কোন জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করি না। সেই সাথে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের গ্রেড একই হলে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কাও নেই। কারণ কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করে পদ দিয়ে, গ্রেড দিয়ে নয়।
এই বিষয়টি আরো সহজ ভাবে বললে দেখা যাবে যে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণ বর্তমানে ১০ম গ্রেডে অবস্থান করছেন। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন হওয়ার পর প্রধান শিক্ষকরাও ১০ম গ্রেড পাবেন। শুধু তাই নয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার ( ইউইও) ও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (এডিপিইও) একই গ্রেড। অর্থাৎ ৯ম গ্রেডে চাকরি করছেন। তাদের যদি প্রশাসনিক জটিলতা দেখা না দেয় তাহলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মাঝে প্রশাসনিক জটিলতা দিবে বলে মনে করি না।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের শুধু সম্মান দিলে হবে না বরং তাদের আর্থিক বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। কেননা, শিক্ষার মানোন্নয়নে আর্থিক বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা আরো বেশি শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বৈষম্য নীতি সৃষ্টি হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে গুরুত্ব দিয়ে প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য ও পদোন্নতির ব্যাপারে ভাবতে হবে। বলা বাহুল্য, বৈষম্য নিয়ে উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র যাদের হাত ধরে আলোকিত হবে, তারা যেন স্বাচ্ছন্দ্যভাবে পাঠদান করাতে পারে, তারা যেন স্বাচ্ছন্দ্যভাবে জীবন যাপন করতে পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে ।শিক্ষক সমাজ বেঁচে থাকুক আমাদের পরম শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে আর ভালোবাসায় এটাই প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যনীতি কাম্য নয় মু সায়েম আহমাদ মুক্তমত