ফুটবল বিশ্বকাপে মাতাল বাঙালি
২০ নভেম্বর ২০২২ ১৩:১৮
দুইদিন পরই কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল। এরই মধ্যে ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ফুটবল টিম জায়গা করে নিতে না পারলেও ফুটবল বিশ্বকাপের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। বিশ্বকাপ এলেই যেন বাংলাদেশে একটি নতুন উৎসব শুরু হয়। বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগ থেকেই শুরু হয়েছে এ উৎসব। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে অফিসপাড়া, চায়ের কাপে, আড্ডায় সবখানে এক টপিক- বিশ্বকাপ ফুটবল। এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয় ফুটবল খেলুড়ে দেশগুলো হচ্ছে- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মান, ফ্রান্স ও পর্তুগাল।
ফুটবলপ্রেমীরা ভিড় করছেন পতাকা ও প্রিয় দলগুলো জার্সি কিনতে পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোতে কেউ বা আবার দর্জি দোকানে ভিড় করছে বিশাল আকারে পতাকা ও শরীরীরে মাপ আনুযায়ী জার্সি বানাতে। বিশেষ করে দুই দলেরই সমর্থক বেশি বাংলাদেশে। এক ব্রাজিল আর পর দল আর্জেটিনা। এই দুইটি দল নিয়ে দুই দলের সমর্থক এতই মাতামাতি করে যে, যা মাতলামি পর্যায়ে চলে যায়। বাঙালী যে কোন বিষয় নিয়েই বেশি মাতামাতি করে। এ কারণে বলা হয় হুজুগে মাতাল বাঙালী। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় প্রিয় দলের ভক্তদের মাতামাতি এতই বেশি যে মনে হয় যেন দলের জন্য প্রাণটাই দিয়ে দেয়। আর যদি আর্জেটিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকরা মুখোমুখি হয়ে যায় তা হলে কথাই প্রিয় বন্ধুরাও শত্রু হয়ে যায়। শুরু হয় তর্ক যুদ্ধ আর যদি মাতাল বা অন্ধ ভক্ত হয় তাহলে মারামারি পর্যায়ে চলে যায়। হ্যাঁ তবে সব সমর্থক এক নয় কেউ আছেন শুধুমাত্র সমর্থন করেন। তর্কবিতর্ক বা মারামারি কিংবা কোন ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নানান রকম উদ্ভট কাণ্ড করছেন ভক্ত ও সমর্থকরা। আর এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় কিছু সমর্থক পতাকা তৈরি করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পাল্লা দিয়ে পতাকা তৈরি করছেন কুমিল্লার ফুটবল ভক্তরা৷ বরুড়া উপজেলায় আর্জেন্টিনা দলের সমর্থকদের তৈরি ২০০ হাত লম্বা পতাকা হৈচৈ ফেলে দেয়৷ আর তাদের টেক্কা দিতে এবার ৫০০ হাতের দীর্ঘ পতাকা তৈরি করেছে ব্রাজিল সমর্থকেরা৷ বরুড়া পৌরসভার কসামি এলাকার একদল ব্রাজিল সমর্থক তরুণ পতাকাটি তৈরি করে টানালে সাড়া পড়ে যায়৷ বিশাল পতাকাটি দেখতে ভিড় করেন আশপাশের এলাকার শতশত মানুষ৷ সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেরালকাতা ইউনিয়নের সাতপোতা বাজারে শোভা পাচ্ছে ব্রাজিলের ১১০ হাত লম্বা পতাকা। কক্সবাজারেরর প্রধান নদী বাঁকখালীর পাড়ে ১০০ ফুট লম্বা পতাকা প্রদর্শন করেছেন এক ব্রাজিল সমর্থক। পাবনার চাটমোহর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের বালুদিয়ার গ্রামের আর্জেন্টিনার সমর্থক যুব সমাজ ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের আর্জেন্টিনার পতাকা বানিয়েছে। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের শুভ কামনা জানিয়েছে ব্রাজিলের সমর্থকরাও।
দূর থেকে দেখে মনে হবে ব্রাজিলের পতাকায় মোড়ানো বাড়ি। কাছে গেলেই বোঝা যায় পুরো বাড়ি রঙ করা হয়েছে ব্রাজিলের পতাকার আদলে। বিশ্বকাপ ফুটবল আসলেই সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার ব্রাজিল ভক্ত লিটন সরকার এভাবেই রাঙান তার বাড়ি। শুধু বাড়িই নয় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী অভি এন্টারপ্রাইজের একটি গাড়িকেও এঁকেছেন ব্রাজিলের পতাকার আদলে। শহর সিরাজগঞ্জে ব্রাজিলের পতাকার রঙের আদলে বাড়ি রং করেছেন ব্যবসায়ী লিটন সরকার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় পাঁচ লাখ খরচ করে আবু কাউসার মিন্টু নামে এক ব্যক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা টানিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
বিশ্বকাপ চলাকালীন ফুটবল ভক্তদের দেখা যায় প্রিয় দলের পতাকা তৈরি ও বাড়ি রং করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে ও ওড়াতে পারে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। যে যার ইচ্ছে মতো জাতীয় পতাকা বানানো বা উড়ানোর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এদের অধিকাংশই জাতীয় পতাকার মর্যাদা ও এটি ওড়ানো বা বানানোর নিয়মনীতি সম্পর্কে অনবগত।
বর্তমানে অবস্থা এমন হয়ে গেছে, যে কোনো ভিনদেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিজের অবস্থান, কোন দেশে এসেছেন, এ সম্পর্কে শঙ্কিত থাকেন। পতাকা ওড়ানোর সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো, বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে ওড়ানো। কেউ কেউ নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে একটি চতুরতার আশ্রয় অবলম্বন করেন। তারা প্রিয় দলের পতাকার ওপর একটি ছোট আকৃতির বাংলাদেশ পতাকা বেঁধে দেন। এই পতাকা সকাল-সন্ধ্যা, দিনরাত, ঝড়বৃষ্টিতে উড়তে থাকে। অথচ স্পষ্ট নিয়ম রয়েছে সূর্যাস্তের আগে পতাকা নামিয়ে ফেলার। অপরদিকে দুটি পতাকা একটির ওপর আরেকটি বা একটির নিচে আরেকটি উড়িয়ে দুটো পতাকাকেই অবমাননা করা হয়।
জাতীয় পতাকা হচ্ছে, একটি দেশের গৌরব ও সম্মানের বিষয়। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, আদর্শ ও প্রতীক হিসেবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই জাতীয় পতাকা রয়েছে। জাতীয় পতাকার সুনির্দিষ্ট আয়তন, উত্তোলনের নিয়ম সুস্পষ্টভাবে সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত আছে। এর ব্যতিক্রম হলে তথা অবমাননা করা হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষা ও অবমাননা রোধে জাতীয় পতাকা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে বাংলাদেশে বিদেশি পতাকা ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছিলো। ওই রিট আবেদনে বলা হয়, ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের বাংলাদেশি সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করেন। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলো ছাড়া অন্য কোনো স্থানে অন্য রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
মোটকথা হলো, বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে পতাকা ওড়ানোর যে নিয়ম অনুসরণ করা হয়, তাতে প্রথমত, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়। দ্বিতীয়ত, অনুমোদন ছাড়াই বিদেশি পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পতাকা বিধিমালাকে লঙ্ঘন করা হয়।
ফুটবল বিশ্বকাপ প্রতি ৪ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়ে যে উন্মাদনা আর উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাতে আবেগের একটি প্রভাব থাকবে সমর্থকের মনে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের পতাকা কিংবা আইনের চেয়ে ফুটবলের প্রতি আবেগ কখনোই বড় কিছু নয়। এই পতাকার পেছনে আমাদের সংগ্রাম ও জাতীয় চেতনাকে লালন করে জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি