শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা! সমাজ কোন পথে?
২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৭:৩৮
আর্জেন্টিনার জার্সি পড়া শিশু আয়াতের ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-দেয়াল থেকে সে-দেয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ছবির ওপরে ক্যাপশন প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের মনুষ্যত্বে একবার হলেও নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আয়াত’কে হত্যার পর শরীর ছয় টুকরো করার খবর প্রায় সমস্ত দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরোনামে ছাপানো হয়েছে। আয়াত ১৫ নভেম্বর বিকেলে পড়তে গেলে আর বাসায় ফিরে আসে না। খবর নিয়ে আয়াতের বাবা-মা জানতে পারে তাঁদের মেয়ে পড়তে যায়নি। খুঁজে না পেয়ে নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরী করার ১০ দিন পর শিশু আয়াতকে তাঁর পরিবার খুঁজে পায় কিন্তু জীবিত নয় ছয় খন্ড টুকরা রূপে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী এমনটাই ঘটেছে চট্টগ্রামের সোহেল রানার মেয়ে আয়াতের সাথে।
চট্টগ্রামে শিশু আয়াতের হত্যাকান্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আবির নামে একজন ১৯ বছরের তরুণ এই হত্যাকান্ড ঘটায়। আবির শিশু আয়াতকে প্রথমে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য। কিন্তু আয়াতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় ক্রাইম পেট্টোলের দৃশ্য কাজে লাগিয়ে আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরো করে সাগরে ভেসে দেয়। শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা এবং হত্যার পর শরীর টুকরো টুকরো করার খবর কি আয়াতই প্রথম? যদি প্রথম না হয়ে থাকে তবে এমন জঘন্যতম অপরাধ দিনে দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলছে কেন? এর জন্য কি সমাজ দায়ী? যদি সমাজ দায়ী হয়ে থাকে তবে কেমন করে? সমাজ এই দায়ভার কার ওপর চাপাবে?
‘আমার বন্ধু রাশেদ’ সিনেমায় দেখা যায় স্কুলে পড়া কিশোর, তরুণেরা কি বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে কিভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশের সমস্ত সংগ্রাম, আন্দোলনে তরুণেরা এভাবেই মানুষের মুক্তির জন্য নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়েছে, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, মানুষের জন্য নিজের জীবন বলিদান দিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি ৫/৭ জন্য কিশোর বা তরুণ একসাথে রাস্তায় হাটলে কিংবা মোটরসাইকেলের বিকট শব্দে চলাচল করলে মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করে এই ভেবে যে না জানি তারা কি অপরাধ করে বসে। মানুষের মনে এই ভাবনা কি হটাৎ একদিনে তৈরি হয়েছে। না, একদিনে তৈরি হয়নি। হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা কিশোর গ্যাং এর জঘন্যতম অপরাধগুলো প্রতিনিয়ত ঘটার ফলে।
পারিবারিক সহিংসতা, অপহরণ ও ধর্ষণের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুহত্যার সংখ্যা ও ধরন উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিচারহীনতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে শিশুহত্যা বাড়ছে।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় এক দম্পতির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই ঝগড়া চলছিল। এর জের ধরে বাবার বাড়ি চলে যান স্ত্রী। স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে শ্বশুরবাড়িতে আসেন স্বামী। সেখানেও তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে একপর্যায়ে সাত মাস বয়সী ছেলেকে নলকূপের সঙ্গে আঘাত করেন। এতে শিশুটির মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বরের। ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের আশায় প্রতিবেশীদের হাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাঁচ বছরের রিফাত হোসেন প্রথমে অপহরণ, পরে খুন হয়। ঘটনাটি ২০১৮ সালের জানুয়ারির। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরে শামনুন নামের চতুর্থ শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রকে অপহরণের পর হত্যা করেছে অপহরণকারীরা। দুদিন আগে শিশুটিকে অপহরণ করা হয়েছিল। পুলিশ জানায়, অপহরণকারীরা তাকে অপহরণের পরপরই হত্যা করলেও পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। ২০২১ সালে ১২ জানুয়ারি ময়মনসিংহের তারাকান্দায় দিনদুপুরে বাড়ির উঠান থেকে সানজিদা আক্তার নামের এক সাত বছরের শিশু অপহরণের তিন দিন পর পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। অপহরণের পর অপহরণকারীরা মোবাইলে ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করলেও ফোন বন্ধ থাকায় পরিবারের লোকজন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। এরকম হাজারো ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে। তবে কি এরকম জঘন্যতম অপরাধের সাথে যুক্ত অপরাধীদের কি কখনো স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে না যে তারা যা করে চলেছে তা আইনের চোখে জঘন্যতম অপরাধ এবং বিবেকের কাছে মনুষ্যত্বহীন, মূল্যবোধহীনতার পরিচয়! রাষ্ট্রযন্ত্র কি তবে এই ভেবে বসে থাকবেন যে কবে অপরাধীর মনে হবে অপরাধ করা যাবে না? বিচারহীনতার সংস্কৃতি একই অর্থ বহন করে না কি? বিচারহীনতার ব্যাড়া জালে পরে সমাজ কি তবে মনুষ্যত্ববোধী মানুষ তৈরি করতে পারবে না?
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর তথ্য মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল এই ৫ বছরে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫২৬ শিশু। নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ শিশু। ২০১৭ সালে শিশু হত্যা ৩৩৯। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ জন শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ৯০১ শিশু। অপহরণ, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড সহ জঘন্যতম অপরাধের পরিমাণ দিনে দিনে কিভাবে বেড়ে চলেছে তা এই পরিসংখ্যান দেখে বোঝবার অপেক্ষা রাখে না। তবে কি এসব অপরাধ বিবেকবান, মনুষ্যত্ববোধ যুক্ত মানুষ তৈরির মধ্যদিয়ে দমন করা যাবে না? গেলে রাষ্ট্রের সর্বত্র ভূমিকা পালন করতে হবে। আর তার জন্য পাঠ্যবইয়ে এই জাতীয় লেখা প্রকাশ করা প্রথম স্টেপ মনে করছি।
নারী-শিশু অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, এসব ঘটিয়ে মন না ভরে শেষে হত্যা করে শরীর টুকরো টুকরো করে ফেলার মতো জঘন্যতম অপরাধের সাথে যুক্ত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পারলে সমাজ তথা দেশ প্রগতির পথে না হেটে উল্টো বর্বর সমাজে পরিনত হবে। প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরের (২০০২-১৬) ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যার ২১ শতাংশ মামলা ১১ থেকে ১৫ বছর ধরে ঝুলেছিল। আর ধর্ষণসংক্রান্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে। বিচারহীনতার রেকর্ড ভাঙ্গতে হবে। রাষ্ট্র যদি ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয় তবে কি সমাজের বিবেকবান মানুষেরা চুপ করে বসে থাকবে? এরকম জঘন্যতম অপরাধ আজকে আয়াতের সাথে হয়েছে আগামীকাল যে আপনার এবং আপনার পরিবারের সাথে ঘটবে না গ্যারান্টি কি?
নারী-শিশু অপহরণ, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা এবং হত্যার পর শরীর টুকরো করার মতো জঘন্যতম অপরাধ অপরাধীরা কেন ঘটাচ্ছে তার ভেতরের কারণগুলো অনুসন্ধান করে বেড় করতে হবে। পাঠ্য বইয়ে এই বিষয়ে লেখা ছাপাতে হবে। মনে রাখতে হবে মনুষ্যত্ববোধী, বিবেকবান মানুষ হওয়ার পেছনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জাফর হোসের জাকির মুক্তমত শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা! সমাজ কোন পথে?