জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক: যার জীবনী আমাদের জন্য বড় শিক্ষালয়
২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৭:৪৯
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, মতান্তরে ১৯১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এবং ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক সক্রেটিসের ন্যায় সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জনে। কিংবদন্তিতূল্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সাথে তুলনা করেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত শিং। জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে ছিলেন চিরকাল। যার কাছে জগত-সংসার ছিল গৌণ আর জ্ঞানার্জনটা ছিল মুখ্য। যিনি ছিলেন শিক্ষকদেরও শিক্ষক। এমনই ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। যাকে পরবর্তীতে “জ্ঞানতাপস” বলে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৩১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে এ বিভাগ থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। পদোন্নতির আবেদন করতেন না বিধায় তিনি দীর্ঘকাল জ্যৈষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে বিখ্যাত অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করার জন্যে লন্ডন গমন করেন; তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ। ১৯৫০ সালে আব্দুর রাজ্জাক গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেবার আগেই প্রফেসর লাস্কির মৃত্যু হয়। লাস্কির মতো শিক্ষকের মৃত্যুতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রচন্ড মর্মাহত হন এবং গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। লাস্কির মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ নবীন অধ্যাপক মরিস জোন্সকে তার সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত করে। থিসিসের কাঠামোর সাথে মরিস জোন্সের মতানৈক্য দেখা যাচ্ছিল। আর তাছাড়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের নিজের পান্ডিত্য এবং মেধার ওপর ছিলেন আস্থাশীল এবং আত্মবিশ্বাসী। এর সাথে প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যু মিলিয়ে থিসিসের কাজ শেষ পর্যায়ে এনেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন থিসিস জমা না দেয়ার। তারপরও বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে তিনি থিসিস জমা দেন, কিন্তু পরীক্ষকগণ থিসিসের ফুটনোট সুসংবদ্ধ নয় বলে অভিযোগ তোলেন এবং তা পুনরায় ঠিক করে জমা দেয়ার আহবান জানান। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেয়ার আহবান জানায়।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বিস্তর গবেষণা করে তাঁর যে জ্ঞানসাধনা ও জীবনাচারের পরিচয় পাওয়া যায় তার সাথে প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িক দার্শনিকদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তার শিষ্য আহমদ ছফা ব্রাত্য রাইসু ও সাজ্জাদ শরিফের সঙ্গে এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, “রাজ্জাক সাহেবের একটা স্টোয়িক ব্যাপার-সেপার আছে, স্টোয়িসিজম আছে তার মধ্যে।” তিনি কথাবার্তার মাধ্যমে তার জ্ঞানালাপ চালিয়ে যেতেন বলে অনেকে তাকে এদিক থেকে সক্রেটিসীয় পদ্বতির জ্ঞানসাধক ভাবেন।
তাকে অনেকে বলে থাকেন স্বাধীন বাংলাদেশের তাত্ত্বিক রূপকার। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য তিনিই প্রথম সবার নজরে আনেন এবং এ থেকেই দুই অর্থনীতি তত্ত্ব, ছয়দফা ইত্যাদির জন্ম হয়। অধ্যাপক রাজ্জাকের পান্ডিত্যের জন্য দেশ বিদেশের নানা গুণীজন তার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ডিক উইলসন তাঁকে বই উৎসর্গ করেছিলেন, খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিল সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রী।
১৯৭৩ সালে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত ছিল বিশেষত প্রাশ্চ্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতিতে।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্ভেদ্য এবং রহস্যময়, কেননা জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন, তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যাননি, যার জন্য তার দর্শন, মতবাদ, চিন্তাচেতনা কিংবা পান্ডিত্যের রেশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেবলমাত্র তার শিক্ষকতা এবং শিক্ষকতা পরবর্তী সময়ে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারাই জানেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক কতটা মহান ব্যক্তি এবং জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও তার বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেতো। কেননা খদ্দরের পাঞ্জাবী-পায়জামা আর মাঝে মাঝে কাঁধে একটি চাদর কিংবা লুঙি আর কুর্তাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কেবলমাত্র অতীব জরুরি প্রয়োজন, যেমন- বিলেত গমন বাদে কোট-টাই পরতে তার প্রচুর অনীহা ছিল।
ফুলার রোডের লাল ইটের দোতলা এক বাসায় থাকতেন, যেখানে সবসময় তার ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জ্ঞানের আড্ডা ছিল তার কাছে অত্যন্ত পছন্দের ব্যাপার। জ্ঞানের ভারে ন্যুব্জ এই ব্যক্তি জ্ঞান বিলাতেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসতেন। বই পড়া এবং সংগ্রহ করা বাদে তার আরো দুটি নেশা ছিল, আর তা হচ্ছে বাজার করা এবং রান্না করা। তার বাসায় প্রতিনিয়ত যেসব ছাত্র-ছাত্রীর যাতায়াত ছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই তার হাতের রান্না খেয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তিনি শুধুমাত্র জ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন না, অনেক ছাত্রী, এমনকি অনেক ছাত্রের বউয়ের রান্নার শিক্ষকও ছিলেন। রান্না করার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল তার। বাজার করতেন বেশ সময় নিয়ে।
তিনি প্রায়ই বলতেন, আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি। এক কাঁচাবাজার, অন্যটা হলো বইয়ের দোকান। আমার মনে হয়, কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে দেশে বইয়ের দোকান নাই সে দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায়, দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়।
অবসরের বিনোদন হিসেবে দাবা খেলা ছিল তার বেশ পছন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়টুকু তিনি বই পড়েই কাটাতেন। সন্ধ্যায় দুই ঘন্টা দাবা নিয়ে মেতে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেন জীবিত থাকাকালীন তিনিই ছিলেন তার দাবা খেলার একমাত্র সঙ্গী। দাবা খেলার বসলে এই দুজনের দুনিয়ার আর কোনো বিষয়ই খেয়াল থাকতো না। এরকম খেলায় মশগুল হয়ে মোতাহার হোসেনের ড্রয়িং রুমের সোফায় বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। মোতাহার হোসেন গত হওয়ার পরও তিনি দাবা খেলতেন কখনো একা একা অথবা ছাত্র বা শিক্ষকদের সাথে।
দাবার গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক স্যারের স্নেহতুল্য। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে বসে খোশমেজাজে গল্পগুজব করাই ছিল আব্দুর রাজ্জাকের অন্যতম বিনোদনের অংশ। একদিন এক ছেলেকে ডেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে, এই ছেলে অর্থনীতি খুব ভালো বোঝে। ছেলেটি ছিল নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন!
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক চল্লিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান আর নিজেকে সকলের স্তরে। তাকে বলা হতো শিক্ষকদের শিক্ষক। তবুও তাঁর শিক্ষকতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘আব্দুর রাজ্জাকের কল্লা চাই’ স্লোগান উঠেছিল। আর যে বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো ছাত্র আর শিক্ষক পেয়ে ধন্য হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিল। অবশ্য দুটো মামলাতেই স্যারের জয় হয়েছিল। এ জয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শাসন-শোষণ আর স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে। তবে শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে তার প্রচন্ড অনীহা ছিল। তিনি অকপটে স্বীকার করতেন, ক্লাস নেয়াটা তার ধর্তব্যের মধ্যে নেই। তিনি সবচাইতে বেশি আনন্দ পেতেন যদি ছাত্ররা কোনো বিষয়ে জানার অভিপ্রায়ে হোক আর এমনিতেই হোক তার কাছে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপ করে।
সত্যিকার শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না। ছাত্রদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবেন। সস্নেহে চেয়ে থাকেন তার ছাত্রটি কবে মানুষের মতো মানুষ হবে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন তেমনই একজন। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করেছেন তিনি। কেউ যদি বলেন, স্যার এ সাহায্যটুকু করতে হবে। তখনই কাঁধে চাদরটা দিয়ে তাকে নিয়ে হাঁটা ধরতেন। কখনো কাউকে ‘তুমি’ করে বলেননি। সকল ছাত্রকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক একবার হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করতে যাবেন। আর এজন্য তিনি ময়লাযুক্ত পুরোনো জামাকাপড় পরে গায়ে একটা পুরোনো চাদর নিলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো স্যার আপনি হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করবেন এরকম পোশাকে? আপনার আর জামাকাপড় নেই? তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমার তো আর জামা কাপড় নেই।
আরও একটা ঘটনা বলি, তিনি যে ঘরের যে খাটে (চৌকি) ঘুমাতেন সেই খাটের (চৌকির) একটা পায়া ভাঙ্গা ছিলো আর তিনি সেখানে বই দিয়ে পায়ার কাজ চালিয়েছেন। কতটা সহজ সরল মানুষ হলে কেউ এরকম জীবনযাপন করতে পারে! তাও আবার ঢাবির প্রফেসর হয়ে!
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের চরিত্রের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের দেখা পাওয়া যায় আহমদ ছফার “যদ্যপি আমার গুরু” গ্রন্থে।
আহমদ ছফার ভাষায়- “যে সলিমুল্লাহ খান রাজ্জাক স্যারকে বকাঝকা করে আস্ত একটা বই লিখেছিলেন, পরবর্তীতে যখন সলিমুল্লাহ খানের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্জাক স্যার ও ড. কামাল হোসেনের সুপারিশের প্রয়োজন হয়েছিল তখন তিনি প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন এবং ড. কামাল হোসেনের প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। এমনকি সলিমুল্লাহ খান যখন আমেরিকা যান তখন প্লেন ভাড়ার একটা অংশ দিয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। এই ছিলেন রাজ্জাক স্যার।”
এই সুপারিশ যা কিনা সলিমুল্লাহ খানের বিদেশ যেতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আহমেদ ছফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার আপনি কি সলিমুল্লাহর লেখা বইটি পড়েছিলেন?” স্যার উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ পড়েছি।
এই হলেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক। যিনি জ্ঞানের বাতিঘর হয়েও জীবদ্দশায় কোনো বই লিখেননি। আহমদ ছফা’র মাধ্যমেই আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে বিস্তর জানা যায়। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের জীবনী থেকে আমরা কি শিক্ষা নিয়েছি?
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি