জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশ
৩০ নভেম্বর ২০২২ ১৮:২০
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, বাংলাদেশে যে অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী নেতিবাচক এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে তার যাবতীয় চুলচেরা বিশ্লেষণকে বুঝায়। ইউএনএফসিসিসি (UNFCCC) বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে মানবসৃষ্ট আর জলবায়ুর বিভিন্নতাকে অন্যান্য কারণে সৃষ্ট বলে অবহিত করেন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণে নয়, এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণও অন্তর্ভুক্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিপর্যয়ের এ ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কতৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ্যাকশন প্ল্যান (NEMAP)-এ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসাবে চিহ্ন করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মানুষই দায়ী। বনভূমি ধ্বংস, কার্বন ডাই-অক্সাইড বির্গমন, CFC গ্যাস নির্গমন, পরিবেশের প্রতি হুমকিস্বরুপ প্লাস্টিক ও পলিথিন সামগ্রী ব্যবহার, পানিতে আর্সেনিক বিষের মিশ্রণ, শব্দ দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মারণাস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহারের ইত্যাদির ফলে মানুষ নিজেই পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যপী সৌর তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা উষ্ণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বিরুপ প্রভাব হচ্ছে সমুদ্রে পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। গত ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। সমুদ্র উপকূল এলাকায় হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূল প্রভাবগুলোর কারণে বাংলাদেশ নাজুক পরিস্থিতির শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বশেষে তিন বছরের প্রতিবেদনে ২০০ টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানেই রয়ে গেছে। ১৯ বছর ধরে দুর্যোগের সংখ্যা,মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসেবের ভিত্তিতে ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০১৮’ প্রতিবেদনটি ‘জার্মান ওয়াচ’ প্রকাশ করেছে।জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘Intergovernmental panel on climate change (IPCC)’ এর মতে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (CRI) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের উপর। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড (Poster Child) হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে বসবাসকারী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়াও বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।
‘জলবায়ু সংকট কার্যত শিশু অধিকারের সংকট: শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের এই সূচকটি ইউনিসেফের প্রথম শিশু-কেন্দ্রিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক। শিশুদের ঘূর্ণিঝড় ও তাপপ্রবাহের মতো জলবায়ু ও পরিবেশগত আঘাতের সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টির পাশাপাশি তাদের অপরিহার্য পরিষেবা প্রাপ্তির সুযোগের ভিত্তিতে তারা এসব আঘাতের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে দেশগুলোকে ক্রমানুসারে স্থান দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারত – দক্ষিণ এশিয়ার এই চার দেশে শিশুরা জলবায়ু সংকটের প্রভাবসমূহের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এই চার দেশের অবস্থান যথাক্রমে ১৪, ১৫, ১৫ ও ২৬ নম্বরে। নেপালের অবস্থান ৫১, শ্রীলঙ্কা আছে ৬১তম স্থানে। ভুটান আছে ১১১তম অবস্থানে, যেখানে শিশুরা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে আছে। প্রায় ১০০ কোটি শিশু ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা ৩৩টি দেশে বসবাস করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, ‘প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি একত্রে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকট তৈরি করেছে। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় – আমরা যদি পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করি, তাহলে পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং অবনতিশীল পরিবেশের প্রভাব থেকে তাদের ভবিষ্যতকে আমরা রক্ষা করতে পারি।’
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই শিশুরা নদীবাহিত বন্যা ও বায়ু দূষণের কারণে ক্রমাগত বিপদের মধ্যে রয়েছে। তবে এটিও উঠে এসেছে যে, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করা হলে তা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শিশুদের সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ৬০ কোটিরও বেশি শিশুর বসবাস এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর বসবাসও এই অঞ্চলে। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে। তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড ও খরার মতো চরম জলবায়ু-সংক্রান্ত ঘটনাগুলো প্রতি বছর এই অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া এবং আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যতকে ক্রমাগত ঝুঁকিতে ফেলেছে। আরও খারাপ দিকটি হচ্ছে – তারা একটি বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, যা অর্জিত যে কোনো অগ্রগতিকে উল্টে দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, যেখানে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয় সেখানেই যে শিশুরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় জলবায়ু-চালিত প্রভাব মোকাবিলা করে তা সঠিক নয়। দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশসহ ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত ৩৩টি দেশ সম্মিলিত ভাবে বৈশ্বিক কার্বন -ডাই -অক্সাইড নির্গমনের মাত্র ৯ শতাংশ নির্গমন করে। অন্যদিকে, মাত্র ১০টি দেশ সম্মিলিত ভাবে বৈশ্বিক নির্গমনের ৭০ শতাংশ নির্গমন করে।
লারিয়া-আদজেই যোগ করেন, ‘বিশ্বজুড়ে আমরা যে ভয়ঙ্কর পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো দেখছি তা কয়েকজনে মাধ্যমে ঘটছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে অনেককে। আমাদের অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তর স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলার জন্য একটি কমিউনিটি হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ১৮০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৪ বছরের নিচে। তারাই এই পরিবরতনের মূলে আছে।’
গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপ না নিলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুগতে থাকবে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শারীরিক ওজনের প্রতি ইউনিট বেশি খাবার ও পানির প্রয়োজন হয়, চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনায় তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম এবং রাসায়নিক, তাপমাত্রা পরিবর্তন ও রোগের প্রতি অনেক বেশি মাত্রায় তারা সংবেদনশীল।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র একটি দেশ বা প্রতিষ্ঠান কিংবা জাতিসংঘ সহ অন্যান্য সংস্থার প্রচেষ্টা দ্বারা এটির মোকাবিলা সম্ভব নয়। প্রত্যেক দেশের প্রতিটি মানুষ যদি নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনতার মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করে তবেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি