বিজয়ের মাসে হৃদয়ে বাংলাদেশ
১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৫৯
আমার মা আমাকে একদিন ডেকে একটি ইংরেজি শব্দ অনুবাদ করতে দিলেন। আমি কাজটি শেষ করে মাকে জমা দিলাম। অনুবাদের জন্য আমি যে টাকা পেলাম তাই দিয়ে কিনলাম একটি ঘড়ি। আজও সেটি বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো আমাকে সাহায্য করে চলেছে। আমার সেই ইংরেজি শব্দটি অনেককেই নানাভাবে সাহায্য করে চলেছে। কিন্তু আমার দুঃখ, প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ সে কাউকে দেয় না। দেশের মানুষকে ভালোবাসার চরম মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে শব্দটি প্রাণ দেওয়ার পথে। আমি নতুন করে বিজয়ের মাসে সেই শব্দটি ফিরে পেতে চাই।
কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের রানী মারা গেলেন। প্রিন্স চার্লস মুহূর্তে রাজা হয়ে গেলেন। যাদের পূর্ব-পরিচয় বা ঐতিহ্য আছে তারা ইতিহাস তৈরি না করতে পারলেও পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু যাদের সে সুযোগ নাই তারা কি সারা জীবন ইতিহাস পড়েই জাবে? আমার ভিতর জিদ চেপেছে সেই বহু বছর আগের জিদ। জিদটা হলো ইতিহাস পড়ব না বরং ইতিহাস তৈরি করব। কীভাবে এটা সম্ভব? আলোচনায় যাবার আগে কিছু ঘটনা তুলে ধরি। চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল, সবাই মেসি হতে চায়, সবাই মেসির মত খেলতে চায়, এমনকি দর্শকও সবাইকে মেসির সঙ্গে তুলনা করে। মেসি তার মত করে খেলে আর বাকীরা তার মত করে খেলতে চায়। এই চাওয়াটা আমার কাছে অনেকটা ইতিহাস পড়ার মত গড়ার মত নয়। বিশ্বে যা কিছু চিরো কল্যাণকর তার সব কিছুই ইউনিক। যা ছিল না, হয়েছে, যা অতীতে ঘটেনি ঘটেছে, যা দেখিনি, দেখেছি। এসব ঘটনা প্রবাহ এখন আর নতুন কিছু না। সবাই যদি মেসির মত খেলে তবে নিউজ হবে না এমন কি গোলও হবে না। নতুন করে এমন খেলেয়াড় তৈরি করতে হবে যার আগমনে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে। আরেকটি উদাহরণ দেই। টেনিস প্লেয়ার শিরিনা এবং ভেনুস উইলিয়াম যখন টেনিস জগতে এল। বিশ্ব জিঙ্গেস করেছিল তোমরা কি হতে চাও? বড় বোন ভেনুস বলেছিল সে বিশ্ব সেরা হতে চায়, শিরিনা বলেছিল সে এমনভাবে টেনিস খেলতে চায় যেন সবাই তাকে ফলো করে। শিরিনা ২৩টি গ্রান্ড স্লাম শিপোপা জিতেছে, এখনও মেয়েদের বেশির ভাগই তার মত করে টেনিস খেলতে চায়। ইতিহাস গড়তে হলে হবে কি শিরিনার মত করে টেনিস খেললে? একই অবস্থা মেসি হলে হবে না নতুন করে নিউ লুক, নিউ ইমেজে নতুন খেলার ধরণ নিয়ে যে আসবে সেই হবে পরবর্তী ইতিহাস তা নাহলে এভারেজ হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশ যদি সারাক্ষণ বিশ্বকে ফলো করে কি হবে? তেমন কিছু হবে না যেমন আছে তেমন থাকবে, তবে যদি এই ভাবে দেখি যেমন দেশ হিসাবে কি এমন পরিচয় আছে আমাদের? পরিচয় যখন নেই তখন নতুন পরিচয়ে বাংলাদেশ গড়লে কেমন হয়? সে আবার কি? এবার আসুন এ নিয়ে আলোচনা করি।
আমি এ মুহুর্তে সুইডেনে বসবাস করছি। বাংলাদেশের আমলাদের কাছে আমার পরিচয় আমি প্রবাসি কামলা। কারণ যারা দেশের বাইরে কাজ করে তাদেরকে সেই ভাবেই ট্রিট করা হয়। এটা দেশের আমলাদের ব্যর্থতা যে তারা প্রবাসীদের ওপর ভালো ধারনা তৈরি করতে পারেনি। আমার সমস্যা নেই কামলা নামে পরিচিত হতে তবে সমস্যা হতো যদি কেউ দুর্নীতি বা ঘুষখোর বলে বা অপরাধী বলে ঘৃণা করত। মজার ব্যপার যে আমি শুধু সুইডেনে না গোটা বিশ্বে কামলাদের কাজের ম্যানেজমেন্ট করে চলছি কমপক্ষে তিন যুগ ধরে। যার ফলে আমার মধ্যে চেতনা এসেছে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ার।
সুইডেন কী করে। ইন্ডাস্ট্রিতে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করে, গাড়ি, বাড়ি, কল কারখানা, অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, ওষুধ সহ নানা ধরনের টেকনোলজি। এর সবকিছু নিজেদের চাহিদা মিটাতে সাহায্য করে এবং পরে অতিরিক্ত যা থাকে সেগুলো বিদেশে এক্সপোর্ট করে বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে গ্লোবাল প্রভাইডার হিসাবে আত্নপ্রকাশ করে। যুগ যুগ ধরে এমনটি করেই তারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে চলছে। পক্ষান্তরে আমদের পরিচয় আমরা বিশ্বের অন্নের ধ্বংসকারী, ঋণধারী, বিশ্বের নিম্নসারির নাগরিক হয়ে পরিচিত হয়ে দিব্বি চলছি। অথচ দেশের যারা এলিটধারি, যারা আমাদের কামলা বলে সম্মোধন করে তাদের এ নিয়ে কোন জ্বালা নেই শরীরে, কিন্তু আমার শরীরে জ্বালা আছে, এজ্বালা আমি দূর করতে চাই। যদি বলি নতুন পৃথিবী গড়তে হবে। যে পৃথিবীতে অস্ত্র তৈরি করব না, আমরা অস্ত্র বিক্রি করব না, আমরা মাদক তৈরি করব না, আমরা মানুষ খুন করার কেমিক্যাল তৈরি করব না, আমরা মানুষকে ঋণ দিয়ে পুঙ্গ করে দিব না। আমরা জ্ঞান বিক্রি করব। প্রতিবছর হাজার হাজার কোয়ালিটি সম্পন্ন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, ক্লিনার, বাবুর্চি, নিরাপত্তা বাহিনী সহ সৃজনশীল পুস্টি ও সৃজনশীল ম্যানার তৈরি করে গোটা বিশ্বে সে গুলো সাপ্লাই করব এবং নিজেদের চাহিদা মেটাব, তাহলে আমরা বিশ্বে সুইডেনের মত নয় বাংলাদেশের মত করে বিশ্বকে নতুন করে লিড দিতে পারব। ফুটবলের মাঠে মেসি খেলে মেসির মত, রোনাল্ডো খেলে তার মত। বাংলাদেশ যদি মনে করে তার এ আত্নবিশ্বাস আছে তবে সম্ভব হবে, আর যদি মনে করে আজীবন পরের গোলামী করবে, ভিক্ষা নিবে, দুর্নীতি করবে শোষণ করবে দেশের গরীবদের, তাহলে হবে না। সারা জীবন চামচামি করতে করতে দেশের আমলারা মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েছে। লজ্জা শরম বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। এভাবে চলতে থাকলে মেরুদন্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এ ধরণের আমলাতন্ত্র এবং শাসনতন্ত্রের অবশান ঘটাতে হবে এবং দেশে রেভুলেশন ঘটাতে হবে প্রতিটি জাগ্রত জনতার মাঝে। জনগণের কাছে গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের আত্মসম্মানবোধ বাড়াতে হবে। কোয়ালিটি সম্পন্ন সঠিক এবং সুশিক্ষা দিতে হবে। স্বৈরাচারীদের দেশ থেকে সরাতে হবে। গণতন্ত্রের ঢেউ মুখে মুখে আনলে হবে না। প্রটোকল তৈরি করতে হবে যেখানে থাকবে কমিটমেন্ট যেমন ক্ষমতায় গেলে কী পরিবর্তন হবে এবং কি না হবে ইত্যাদি।
আমাদের নিরবতা নতুন প্রজন্মের জন্য হতাশার বার্তা। আমাদের প্রশাসনের ওপরও আস্থা বাড়াতে হবে, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে আজ, কারণ দেশ স্বাধীন করেছিলাম যে উদ্দেশ্যে সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
আমরা বিষয়বুদ্ধি নিয়ে আপন সিদ্ধি খুঁজি। আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা নির্বাহে আমাদের জ্ঞান, কর্ম, রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত এবং সেখানে আমরা জীবরূপে বাঁচতে চাই।
স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীব-প্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগ ও তপস্যার দিকে নিয়ে যায়, যাকে বলি মনুষ্যত্ব (humanity)। আমি এখনও বিশ্বাস করি সোনার বাংলায় এখনও কেউ আছে যে তার দেশের কথা ভাবে, এখন সেই ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে তা না হলে স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নই হয়ে রবে।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি